
‘মাত্র ১০ মিনিট আগে ঘর থেকে বের হয়েছিল। বলেছিল, আম্মু ঘরে ময়লা ছিল। আমি ঝাড়ু দিয়েছি। একটু খেলতে যাচ্ছি। একটু পর খবর আসে আমার আব্বা নেই। আল্লাহ এটা কী হলো।’
বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন রোফা আকতার। বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) এলাকায় পাহাড়ধসে মাটিচাপা পড়ে মারা গেছে তাঁর শিশুসন্তান মিসবাহ হোসেন (১১)। এ ঘটনায় মো. রোহান নামের আরেক শিশুরও মৃত্যু হয়েছে। তার বয়সও ১১ বছর।
ঘটনার সময় সেখানে ছিল মিসবাহ ও রোহানের সহপাঠী মো. ইমরান। সে জানায়, তারা আট-নয়জন টিলা আকৃতির একটি কাটা পাহাড়ের জায়গায় খেলতে যায়। রোদের তাপে গরম লাগলে কাটা পাহাড়ের অংশের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এ সময় হঠাৎ পাহাড় ধসে পড়ে। সেখান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে একজনকে উদ্ধার করে তারা। পরে পাশের বাড়িতে গিয়ে খবর দেওয়া হয়। সেখান থেকে লোকজন গিয়ে তিনজনকে উদ্ধার করে। এর মধ্যে রোহান ও মিসবাহ মারা যায়।
মিসবাহ ষষ্ঠ শ্রেণি ও রোহান পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। দুজনই বৈরাগ ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডে নুরুজ্জামানের বাড়ির বাসিন্দা। বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায় রাস্তাঘাটে মানুষের জটলা। শোকাতুর মানুষগুলোকে পাশ কাটিয়ে মিসবাহদের ঘরের আঙিনায় পৌঁছাতেই ভেতর থেকে রোফা আকতারের আর্তনাদ ভেসে আসে।
তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিল মিসবাহ। তাদের বাবা মো. ইমরান টেইলার্সের কাজ করেন। তিনি হাসপাতালে ছেলের মরদেহের কাছে ছিলেন। মা রোফা বিছানায় বসে বিলাপ করছিলেন। বললেন, ‘সেদিন আমার ছেলে পারকি বিচে গেছে কয়েকজনের সঙ্গে। সুন্দর করে ছবি তুলে আমাকে দেখাল। বলল, মা দেখো আমি কী সুন্দর করে ছবি তুলেছি। আজ আমার ছেলেটা নেই।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পাহাড়গুলো এভাবে কেটে রাখার কারণে রোদের মধ্যেও সেগুলো ধসে পড়েছে।
রোহানদের ঘর পাশেই। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রোহান সবার বড়। তার বাবা আবদুর রহিম টমটম চালান। তিনি এখন বাক্রুদ্ধ। খাটে শুয়ে আছেন। একটু পর রোহানের ফুফু এসে রহিমকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘তুই কোথায় ছিলি, ভাই? রোহানকে কেন বাাঁচাতে পারলি না।’ পাশের ঘরে ছেলের নাম ধরে বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মা ডেইজি আকতার।
স্থানীয় কামাল উদ্দিন বলেন, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রোহান প্রতিদিন ভোরে ফজরের নামাজের সময় হলে পাশের মসজিদে গিয়ে আজান দিত। কেইপিজেড এলাকায় বন্য হাতির উৎপাত রয়েছে। তবে হাতিকে ভয় পেত না সে।
কেইপিজেডের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে। সেখানকার উঁচু পাহাড়গুলো কেটে কোনোটি সমতল এবং কোনোটি টিলা আকৃতির করা হয়েছে। কাটা পাহাড়গুলোর মাঝখানে ফাটল রয়েছে। পাহাড়ের এই কাটা অংশগুলোর একটি ধসে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত সিয়াম ও সিফাতকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পাহাড়গুলো এভাবে কেটে রাখার কারণে রোদের মধ্যেও সেগুলো ধসে পড়েছে। কোনো বৃষ্টি না থাকার পরও এভাবে পাহাড়ধস মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা। তাঁদের অভিযোগ, কেইপিজেড অপরিকল্পতভাবে পাহাড় কাটায় এই ধসের ঘটনা ঘটেছে।
কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাটা যে পাহাড়ে ধসের ঘটনা ঘটেছে, সেটি বেশি উঁচু নয়। ওখানে নিচের দিকে শিয়ালের গর্ত রয়েছে। ছেলেগুলো সেখানে খেলতে যায়। তারা শিয়ালের গর্ত থেকে আস্তে আস্তে মাটি সরাচ্ছিল। তখন ওপর থেকে কিছু মাটি ধসে তাদের গায়ের ওপর পড়ে। আমরা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পাশে আছি।’
ঝুঁকিপূর্ণ কাটা পাহাড়গুলো কেন এভাবে রাখা হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে মুশফিকুর বলেন, পুরো এলাকার জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে। কিন্তু যেকোনো পাহাড় কাটার জন্য নতুন করে অনুমতি দরকার হয়। ওই এলাকায় কাজ করার অনুমতিটা এখনো পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া যায়নি। তাই এভাবে রয়েছে।
আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেইপিজেডের পাহাড়গুলো আগেই কাটা হয়েছে। এগুলো খাড়াভাবে রয়েছে। ওখানে শিশুরা খেলতে যায়। আজ (বৃহস্পতিবার) পাহাড়ের অংশবিশেষ ধসে ছেলেগুলোর গায়ের ওপর পড়ে। সেখানে মারা যায় দুজন। ভুক্তভোগী পরিবার অভিযোগ দিচ্ছে। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’