একাত্তরে যাঁরা শহীদ হয়েছেন সংখ্যায় তাঁরা অনেক; আমরা বলে থাকি ৩০ লাখ। তাঁদের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন, যাঁদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। কারণ, তাঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন; কেউ কেউ ছিলেন সমাজতন্ত্রী। চারজন ছিলেন আমার অত্যন্ত আপনজন। শহীদ মুনীর চৌধুরীর কথা আমি অন্যত্র লিখেছি, আবারও বড় করে লিখব। তিনজনের কথা এখানে বলছি। তাঁরা হলেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রাশীদুল হাসান ও গিয়াসউদ্দিন আহমদ।
মানতেই হবে যে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও রাশীদুল হাসানের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিল। বয়সে, অভ্যাসে ও রুচিতে যতটা না মিল ছিল, গরমিল ছিল তার চেয়েও বেশি। অন্তত বাহ্যত তা–ই মনে হতো। যদিও তাঁরা দুজনেই ছাত্র ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, সহকর্মী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
তবে তাঁরা কাছাকাছি, খুব কাছাকাছি ছিলেন বিনয়ে; আরও কাছে ছিলেন একে অপরের দেশের প্রতি ভালোবাসায়। সামান্যতার সাধারণ পরিবেশে তাঁরা অসামান্য হয়ে উঠেছিলেন ওই দুই আপাত–সাধারণ; কিন্তু বস্তুত-দুর্লভ গুণে।
জ্যোতির্ময় স্যারের নাম লেখা ছিল মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সেই খাতায়, যেখানে নাম থাকার কথা অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যক্তিদের। এটা তিনি প্রথম টের পেলেন যখন দরখাস্ত করলেন কলকাতায় যাওয়ার পাসপোর্টের জন্য। তাঁর বৃদ্ধ মা দিন দিন দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছিলেন; সেই মায়ের ইচ্ছা ছিল বড় ছেলেকে দেখবেন। এ জন্য ভেতরে–ভেতরে ভারী চঞ্চল ছিলেন জ্যোতির্ময় স্যার, যদিও বাইরে প্রকাশ করতেন না। খুবই প্রকাশবিমুখ ছিলেন তিনি এসব বিষয়ে সব সময়। অনেক চেষ্টা করেছেন তিনি নিজে, তাঁর হয়ে অন্যরাও কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কারোরই সাধ্য ছিল না মিলিটারির
খাতায় যাঁর নাম লেখা রয়েছে ‘কমিউনিস্ট’ বলে, তাঁকে পাসপোর্ট দেয়। প্রভোস্ট ছিলেন তিনি জগন্নাথ হলের। সেই হলের ছেলেরা রাষ্ট্রবিরোধী সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন একটা বানানো সংবাদে সেনাবাহিনী নাকি খুব তপ্ত হয়েছিল এবং শোনা গেছে, প্রভোস্টকে তারা হয়তো গ্রেপ্তার করত ২৫ মার্চের আগেই, যদি না তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভদ্রগোছের একজন লোককে বসানো হতো প্রাদেশিক গভর্নরের পদে। ২৫ মার্চের রাতেই তাঁকে গুলি করেছিল হানাদাররা, সময়মতো চিকিৎসা হলে হয়তো তিনি বাঁচতেও পারতেন; কিন্তু মার্চে বাঁচলেও ডিসেম্বরে বাঁচতেন কি না, খুবই সন্দেহ, যেমন বাঁচেননি সন্তোষ ভট্টাচার্য, বাঁচেননি জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতারই ছাত্র রাশীদুল হাসান।
রাশীদুল হাসানেরও নাম ছিল মিলিটারির গুপ্ত খাতায়। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে তাঁর খোঁজে সশস্ত্র লোকেরা হানা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, হানা দিয়ে ধরে নিয়ে গেল তাঁকে কলাভবনের তাঁর কামরা থেকে। তাঁর খোঁজে সশস্ত্র সেনারা আসবে, এমন গুরুত্বপূর্ণ নিজেকে তিনি ভাবেননি কখনো, সেনাবাহিনীর লোকেরা এসে অনায়াসে তাঁর খোঁজ পেয়েছিল। পরে ডিসেম্বরে আবার যখন আলবদররা এলো, তখনো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই ছিলেন তিনি। যাওয়ার তেমন জায়গাও ছিল না তাঁর এই শহরে। উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে।
জাত শিক্ষক ছিলেন তাঁরা উভয়েই। জ্যোতির্ময় স্যার শিক্ষক ছিলেন আমার, যেমন তারও কিছু আগে শিক্ষক ছিলেন তিনি রাশীদুল হাসানের। জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আমার অনেক ধারণাই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া। আমি যতটা জানি, তার চেয়েও বেশি তাঁর কাছে আমার ঋণ। জ্যোতির্ময় স্যার অসংশোধনীয়রূপে যুক্তিবাদী ছিলেন—বিষয়কে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখতে চাইতেন তার মূল্য নির্ধারণের আগে। সেই জন্য তাঁর সঙ্গে তর্ক ছিল আমার। আসলে তিনি তর্ক ভালোবাসতেন, মনে-প্রাণে ছিলেন গণতান্ত্রিক। সেই জন্য তিনি আহ্বান করতেন বিতর্কে, উৎসাহ দিতেন তর্কে, সর্বোপরি মর্যাদা দিতেন ভিন্নমতের, এমনভাবে দিতেন—যতটা কম লোককেই দেখেছি আমি দিতে আমাদের অগণতান্ত্রিক সমাজে। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে আমি জানি তাঁর সরাসরি ছাত্র হওয়ার অনেক আগে থেকেই। সেই যখন আমি স্কুল ছেড়েছি কি ছাড়িনি, সেই বয়সেই তাঁর লেখা পড়েছিলাম আমি— একটি গ্রন্থ সমালোচনা; মুকতি নামে তখনকার দিনের একটি মাসিক পত্রিকায়।
এম এন রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে খুব ছোট একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন জ্যোতির্ময় স্যারÑঅনেক আগে, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, সেই সময়ে আমাকে বলেছিলেন, তুমি এসো, আর কেউ যদি আসতে চায় এনো। যখন গিয়ে পৌঁছেছি ফ্রেন্ডস সেন্টারের বাড়ির কাছে আমি ও আমার বন্ধু; দেখি, দোরগোড়ায় একা দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। হেসে বললেন, এসো, তোমাদের জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি—যেমন সেদিন, তেমনি পরেও, যেন আমরা আসি, এসে মতামত দিই একটা কিছু এবং তর্ক করি তাঁর সঙ্গে। সব ছাত্রের প্রতিই এ ছিল তাঁর আমন্ত্রণ, উদার ও উষ্ণ। সেই দরজা আছে, তিনি নেই; কিন্তু আছে কি সেই দরজাও?
রাশীদুল হাসানকেও আমি শিক্ষকতা ভিন্ন অন্য কোনো পেশায় চিন্তা করতে পারি না। আমি যে তাঁকে অনেক দিন ধরে চিনতাম, তা অবশ্য নয়। ছাত্রাবস্থায় আমরা আসার আগেই তিনি বের হয়ে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং শিক্ষক হয়ে ফিরে এসেছেন বেশ কিছুদিন পরে। মধ্যবর্তী সময়েও শিক্ষকতাই করেছেন তিনি, কিছু সময় পাবনায়, তারপরে জন্মভূমি বীরভূমে। তিনি লিখতেন। প্রবন্ধ লিখতেন, কবিতা লিখতেন সময়–সময়। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবনেই, সেই উনসত্তর সালে, যখন প্রবল গণ–আন্দোলনের আদিগন্ত ঝড় বইছে দেশব্যাপী। তার আগে পরিচয় হয়নি। কেননা, তিনি যখন যোগ দেন ইংরেজি বিভাগে, তখন আমি শিক্ষা ছুটিতে বাইরে ছিলাম কিছুদিনের জন্য।
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও রাশীদুল হাসান কখনো, কোনো অবস্থাতেই গোপন কোনো সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। বোমাবারুদ তৈরি করেননি; কিন্তু তাঁদের ছিল হৃদয়। জীবন্ত হৃদয়। বোমাবারুদের চেয়েও যা বিপজ্জনক শাসকশ্রেণির পক্ষে। বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন তাঁরা। এই ভালোবাসা দেশের সব বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ছিল কি? ছিল না। অবশ্যই ছিল না। মুৎসুদ্দী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তাঁরা অনেকেই। যাঁরা দেশপ্রেমী ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ততটা অগ্রসর ছিলেন না, যতটা ছিলেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও রাশীদুল হাসান। অথচ অদৃষ্টের সেই পুরোনো ও প্রসিদ্ধ পরিহাস, তাঁরা উভয়েই ছিলেন বলতে গেলে নিরাশ্রয়। জ্যোতির্ময় স্যার আমাদের বলতেন, পাকিস্তানে তোমরা হলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক; আমরা, হিন্দুরা, হিন্দু বলেই তৃতীয় শ্রেণির। পরিহাস করে বলতেন বটে; কিন্তু ব্যাপারটা তো পরিহাসের ছিল না, ছিল মর্মান্তিকরূপে বাস্তবিক। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের আত্মীয়স্বজন বলতে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার প্রায় কেউই ছিলেন না। চমৎকার সুযোগ ছিল ইংল্যান্ড থেকে সরাসরি কলকাতায় চলে যাওয়ার; ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান যে তাঁদের পক্ষে আগের তুলনায় অধিক অনাত্মীয় হয়ে উঠেছিল, সে খবর তো বিলেতে বসে না জানার কোনো কারণ ছিল না। ঘটনাটি অস্বাভাবিক; কিন্তু না, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকছিল; বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে ডাকছিল গেন্ডারিয়ার মনিজা রহমান গার্লস স্কুল (তাঁর একটি লেখা পড়েই আমি ধোলাই খাল চিনেছিলাম, খালটিকে দেখার আগেই)। তাঁরা চলে এলেন, উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য জ্যোতির্ময় স্যারের পক্ষে যতটা সময় থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল, সেটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কাটলেন, প্লেনের।
রাশীদুল হাসান পশ্চিমবঙ্গের লোক, ঢাকায় এসেছিলেন উদ্বাস্তু হয়ে; পরে এখান থেকে ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে একবার চলে গিয়েছিলেন জন্মভূমিতে; কিন্তু আবার চলে আসতে হয়েছে তাঁকে, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর। আত্মীয়স্বজন বলতে প্রায় কেউ–ই ছিলেন না তাঁর ঢাকায়, অথবা পূর্ব পাকিস্তানে। সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন মনে হয় আনোয়ার পাশা, যাঁকে তাঁর সঙ্গেই নিয়ে গিয়েছিল ঘাতকেরা হত্যা করবে বলে। একই সময়ে, একই বাসা থেকে। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল, প্রতিরোধের সব সম্ভাব্য ঘাঁটিগুলোকে দেবে নিশ্চিহ্ন করে। সেই জন্য জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও রাশীদুল হাসান চলে গেলেন, আরও অনেকের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানে। তারা নিয়ে গেছে গিয়াসউদ্দিন আহমদকেও।
গিয়াসউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আমি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়লাম, চাকরিও করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন আমি আছি, সে নেই। গিয়াসউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাড়েনি, আমার অবস্থাও তথৈবচ। বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি ভালোবাসতাম, সে বোধ করি ভালোবাসত আমার চেয়েও বেশি। নইলে একাত্তরে আমরা অনেকেই যখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম, তখন গিয়াসউদ্দিন রয়ে গেল কেন? এই ভয়ংকর সময়টাতে ক্লাস যা হতো, সে তো প্রহসন মাত্র। গিয়াসউদ্দিন ছিল মুহসীন হলের হাউস টিউটর। সেখানে তখন থাকত অসহায় কয়েকজন ছাত্র, যাদের ওপর হানাদাররা একাধিকবার চড়াও হয়েছে; আর ছিল আমাদের গিয়াসউদ্দিন, তার ছিল ভালোবাসা, আর ছিল দায়িত্বজ্ঞান। ১৪ ডিসেম্বর যখন হানাদারদের পরাজয় ঘনিয়ে আসে, সেই সময়ে বিপন্ন ছাত্ররা খাওয়ার পানি পাচ্ছে না দেখে সরবরাহব্যবস্থায় ত্রুটি দূর করা যায় কি না, সেটি দেখতে বের হয়েছিল গিয়াসউদ্দিন, সে অবস্থাতেই আলবদররা তাকে ধরে নিয়ে যায়। আর ফেরেনি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চোখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষকদের ক্লাব দুটিই ছিল মারাত্মক প্রতিষ্ঠান। সেখানে শিক্ষকরা নিয়মিত রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা চালাত বলে তারা নিশ্চিত ছিল এবং ছাত্ররা যে বিপথগামী হয়েছে, তার জন্যও তারা শিক্ষকদেরই সরাসরি দায়ী মনে করত। সে জন্য ২৫ মার্চ রাতে তারা ছাত্রাবাস তো বটেই, শিক্ষকদের আবাস এবং তাদের ক্লাবের ওপরও ট্যাঙ্ক ও কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ক্লাবে তখন কোনো শিক্ষক ছিলেন না, থাকার কথা নয়, কিন্তু এতই উন্মত্ত ছিল ওই হানাদাররা যে তারা পার্থক্য করেনি। নিরীহ কর্মচারী যারা ওই ভবনে ঘুমাচ্ছিল, তাদের কয়েকজনকে হত্যা করেছে। ছাত্রাবাসে ছাত্রহত্যা ও শিক্ষকদের ঘরে ঢুকে শিক্ষক হত্যার ব্যাপারে সেই রাতে তাদের কোনো রকম দ্বিধা বা বাছবিচার দেখা যায়নি। গিয়াসউদ্দিন তো এসব ঘটনা অনুপুঙ্খ জানত; কিন্তু সে ক্যাম্পাস ছাড়েনি। কর্তব্যবোধের শৃঙ্খলে আটকা পড়ে গিয়েছিল।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হারিয়ে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপরিমেয় এবং অপূরণীয়; সেই সঙ্গে বেদনাটা দুঃসহ আপনজনের।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়