
প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীরা ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের নানা মুহূর্তের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। জীবনের মোড় বদলে দেওয়া অধ্যায়, প্রিয়জনের জন্য হৃদয়ের গভীর স্পন্দন অথবা হঠাৎ অপ্রত্যাশিত সুখের উপলব্ধি উঠে এসেছে এসব লেখায়। নির্বাচিত লেখাগুলো প্রকাশ করা হলো প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার এক গ্রাম আবদার। চারদিকে ধানখেত, পুকুর, আর সরু মেঠোপথের পাশে ছোট ছোট ঘর। শান্ত এক সকালেই শুরু হয় অদ্ভুত গুজবের গল্প, যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।
গল্পটি এ বছরের ১২ অক্টোবরের। সেদিন সকালে স্থানীয় মোমেনা খাতুনের বাড়িতে তাঁর একটি ছাগল দুটি ছানার জন্ম দেয়। এর মধ্যে একটি ছানার মুখের গঠন ছিল একটু ভিন্ন। মাথা গোল, মুখ কিছুটা চ্যাপটা। গ্রামের কয়েকজন তরুণ কৌতূহলবশত ছানাটির ছবি তুলে ও ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেগুলো আপলোড করে দেন। তাঁরা লিখে দেন, ‘মানুষের মতো দেখতে ছাগলছানা!’
সেই এক পোস্ট থেকেই শুরু হয় গুজবের ঝড়। ঘণ্টা না পেরোতেই ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে বাজারে, বাজার থেকে পুরো উপজেলা ও জেলাজুড়ে। সবাই দেখতে চান ‘মানুষের মতো ছাগলছানা’। ইতিমধ্যে ঘটনাটি ওই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে কিছু মিডিয়ায় চলে আসে। এতে ঘটনাটি আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়, আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
মোমেনার বাড়ির সামনে সকাল থেকেই মানুষের ঢল। কেউ হাতে থাকা মোবাইলে ছাগলছানার ছবি তুলছেন, সেলফি তুলছেন; কেউ ভিডিও করছেন, কেউ আবার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন সদ্য জন্ম নেওয়া ছোট্ট প্রাণীটার দিকে। কিন্তু দুর্বল শরীরের ছানাটি বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি, সন্ধ্যার আগেই মারা যায়। তবু মানুষের ভিড় কমে না। কেউ কেউ বলছেন, এটা অলৌকিক কিছু। আবার কেউ বলছেন, ‘অমানুষের ছানা’। দিনভর নানান কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে একজন থেকে আরেকজনে। এক টাইমলাইন থেকে অন্য টাইমলাইনে হতে থাকে শেয়ার।
দিনভর মানুষের ভিড় সামলে মোমেনা খাতুন ভীষণ ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়েন। ইউটিউবার ও ভ্লগারদের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছিল তাঁকে। তিনি সবাইকে বলছিলেন, এটা মানুষের মতো দেখতে কিছু নয়। কিন্তু গুঞ্জন থামছিল না। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান তিনি।
পরদিন ১৩ অক্টোবর সকালে প্রথম আলোর প্রতিনিধি হিসেবে আমি সেখানে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় তখনো কিছু কৌতূহলী মানুষের আনাগোনা। লোকজন তখনো আগের দিনের গুজব নিয়ে কথা বলছেন। বাড়ির ছবি তুলছেন। আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলছেন।
সাংবাদিক পরিচয় শুনে প্রতিবেশী মোসা. আসমা খাতুন দূর থেকেই বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। এরপর প্রথম আলোর সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁর চোখে–মুখে ভরসার ছাপ। বললেন, ‘আমি তোমরার পত্রিহা চিনি। তোমরার পত্রিহাত লেইখ্খা দেও, এইডা গুজব, তাইলে মাইনষে বিশ্বাস করব।’
তাঁর কথায় আশপাশের বিভিন্ন বয়সী আরও কয়েকজন এগিয়ে এলেন। তিনি আরও বলেন, ‘এক আডে (গ্রাম্য হাট) যতডি মানুষ অয়, এত্তে বেশি মানুষ বাড়িডার মধ্যে আইছে সারা দিন। আসলে এইডা গুজব। ছাগলের বাইচ্ছা মইরা গেছে, এরপরও মানুষ বাড়ি ছাড়ে না। ছাগলছানার দুই পা, কান, শইল্লের সবকিছু ঠিক আছিল। দেখতে আকৃতি একটু আলাদা আছিন। মোবাইলের ভিত্তে দেইক্কা সবাই আইছে ঠিকই, পরে দেহে এইডা আসলে ওই রহম কিছু না।’
প্রথমে আসমা খাতুনের কণ্ঠে ছিল একরাশ বিরক্তি, কিন্তু প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে তাঁর ভেতরে একটা আস্থা ঝলসে উঠছিল, প্রথম আলো যদি লেখে, তাহলে মানুষ বিশ্বাস করবে যে এই খবর মিথ্যা।
একই ধরনের কথা বলেছিলেন ওই গ্রামের যুবক মো. মানিক। তিনি বলেন, ‘আপনারা তো প্রথম আলো, আপনারা একটা কথা লেখলে মানুষ বিশ্বাস করে। এইডা নিয়া কিছু করেন ভাই। মানুষ এমন কেন!’
মানিক এ ঘটনা সম্পর্কে আরও অনেক কথা বলেন। গ্রামের আরও কয়েকটি গুজবের অভিজ্ঞতা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে শেয়ার করেন। তাঁর এমন বিশ্বাস থেকে বুঝতে পারলাম, গ্রামের মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, সবাই মিথ্যা বললেও ‘প্রথম আলো’ সত্যি লেখে। কথা বলে বুঝতে পারলাম, তাঁদের অনেকেই এখন ছাপা প্রথম আলো পড়েন না ঠিকই, কিন্তু মুঠোফোনে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ফলো করেন, ভিডিও দেখেন, অনলাইনে প্রকাশিত খবর পড়েন।
শ্রীপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আশরাফ হোসেনের কণ্ঠেও বিরক্তির ছাপ। তিনি বলেন, ‘ভাই, এসব গুজব। গবাদিপশুর বিকলাঙ্গ বাচ্চা হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রায়ই গরু বা ছাগলের এমন বিচিত্র গঠন দেখা যায়। এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু মানুষ এসব দেখে ভয় পায়, গল্প বানায়, গুজব ছড়ায়। এভাবে কুসংস্কার ছড়ানো ঠিক না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা দায়িত্বশীল পত্রিকা। এসব গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে আপনারা ভূমিকা নিতে পারবেন। উদ্যোগ নিন প্লিজ।’
এ গল্প কেবল একটি ছাগলছানার নয়, এটি মানুষ ও মিডিয়ার পারস্পরিক বিশ্বাসের গল্পও। গাজীপুরের গ্রামাঞ্চলের মানুষ শহরের অনেক মিডিয়ার নাম না জানলেও প্রথম আলো নামটা চেনেন। তাঁরা জানেন, যদি প্রথম আলো লেখে, তাহলে সেটাই সত্য। যেখানে একদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তেই মিথ্যা খবর ছড়ায়, সেখানে এখনো কিছু মানুষ সংবাদপত্রের ওপর অটল বিশ্বাস রাখে, এই বিশ্বাসটাই সমাজের শক্তি।
দিন শেষে যখন গ্রামের মানুষদের সঙ্গে বসে গল্প হচ্ছিল, তখন এক বৃদ্ধ বলেন, ‘এইডা তো ছাগলের ছানা, কিন্তু মানুষ এমন করল যেন দুনিয়ার শেষ হইয়া গেছে! আগেও তো এমন অনেক বিকলাঙ্গ বাচ্চা হইছে, কিন্তু গুঞ্জন ছড়াইছে কম। এখন মোবাইলে গুজব ছড়ায়।’
একটি গুজবের মাধ্যমে যেমন সমাজে খারাপ প্রভাব পড়ে, তেমনি একটি সত্য প্রতিবেদন সেই প্রভাব দূর করতেও পারে। আবদার গ্রামের সেই দিনের ঘটনা প্রমাণ করে, সত্য প্রকাশের শক্তি এখনো হারায়নি।