জাতিসংঘের তিন প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ।

দেশে প্রতিদিন ১৭৩টি মৃত শিশুর জন্ম হচ্ছে। পাশাপাশি পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৯০টি শিশু প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দৈনিক সারা দেশে ১০ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।
মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর এই বিষাদপূর্ণ পরিসংখ্যান দিয়েছে জাতিসংঘের কিছু প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফের উদ্যোগ ইউনাইটেড নেশনস ইন্টার-এজেন্সি গ্রুপ ফর চাইল্ড মর্টালিটি এস্টিমেশন (ইউএন আইজিএসই) গত ২৪ মার্চ শিশুমৃত্যু ও মৃত শিশুর জন্ম নিয়ে পৃথক দুটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আর ২০২৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ ও ইউএনএফপিএ বৈশ্বিক মাতৃমৃত্যুর প্রবণতাবিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এসব প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ ছাড়া বাকি দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ।
ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩ এপ্রিল যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, মা ও নবজাতকের যত্নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। ১৯৯০ সাল থেকে এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় মৃত শিশুর জন্মহারে বাংলাদেশ শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায়ই অপর্যাপ্ত যত্নের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা রোধ করতে অবিলম্বে বাড়তি বা অতিরিক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
এমনই পরিস্থিতিতে আজ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য, ‘সুস্বাস্থ্যে শুরু, আশাভরা ভবিষ্যৎ’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিনটি উপলক্ষে সদস্যদেশের প্রতি এই আবেদন জানিয়েছে যে সরকারগুলো যেন মা ও শিশুর প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর ইতি টানতে তাদের প্রচেষ্টাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়। পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে নারীর স্বাস্থ্য ও কল্যাণের বিষয়কে তারা যেন অগ্রাধিকার দেয়।
শিশুমৃত্যুতে প্রতিবেশীরা পেছনে
জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর শিশুমৃত্যুবিষয়ক প্রতিবেদন বলছে, দেশে বছরে ১ লাখ ৬ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। অর্থাৎ দৈনিক ২৯০টি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।
প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার (প্রতি হাজারে) পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পর বাংলাদেশেই বেশি। বাংলাদেশে এই হার হাজারে ৩১। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এই হার যথাক্রমে ৫৯ ও ৫৬, নেপালে ২৭। শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে কম শ্রীলঙ্কায়, মাত্র ৬। অন্য তিনটি দেশ ভারত, ভুটান ও মালদ্বীপে শিশুমৃত্যুর হার ২৩।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী যত শিশুর মৃত্যু হয়, তাদের দুই-তৃতীয়াংশ নবজাতক। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যু হয় জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে।
অন্যদিকে মৃত শিশু জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থা ও অবস্থান ভালো নয়। দেশে ১ হাজার প্রসবে দেখা যাচ্ছে ২০টি শিশু মৃত জন্ম নিচ্ছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে হাজারে এমন শিশু জন্ম নিচ্ছে ২৮টি করে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মৃত শিশু সবচেয়ে কম জন্ম নেয় মালদ্বীপে, হাজারে ৫টি। ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় এই হার যথাক্রমে ৮ ও ৬। প্রতিবেশী অন্য দুই দেশ ভারত ও নেপালে মৃত শিশু জন্ম দেওয়ার হার ১২ ও ১৪।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ বলছে, শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ অপরিণত জন্ম, প্রসবকালীন জটিলতা, সেপসিস এবং নিউমোনিয়া। দুটি সংস্থাই বলেছে, এই কারণগুলো প্রতিরোধযোগ্য।
মাতৃমৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিনই
জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩ হাজার ৭০০ প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে গর্ভধারণজনিত জটিলতায়, প্রসবকালে ও প্রসব-পরবর্তী জটিলতায়। প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ১০ জন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১২৩ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। এর চেয়ে মাতৃমৃত্যুর হার বেশি দেখা যায় আফগানিস্তান, নেপাল ও পাকিস্তানে। দেশ তিনটিতে এই হার যথাক্রমে ৬২০, ১৭৪ ও ১৫৪। মাতৃমৃত্যুর হার সবচেয়ে কম শ্রীলঙ্কায়। দেশটিতে ১ লাখ শিশু জন্মে ২৯ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। মালদ্বীপ ও ভুটানে এই হার তুলনামূলকভাবে কম, যথাক্রমে ৫৭ ও ৬০। প্রতিবেশী ভারতে এই হার ১০৩।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সেবার ঘাটতি রয়েছে। তহবিল ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সম্পদের ঘাটতি সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিগত দশকগুলোতে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও মানসম্পন্ন ও সময়োচিত সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে।
মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবার ব্যাপ্তি ও মান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নবজাতকের বিশেষায়িত সেবার ইউনিট সম্প্রসারণ করতে হবে, দক্ষ জনবল বাড়াতে হবে, চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কারবিষয়ক কমিশনের সদস্য ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানূর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিশুমৃত্যু ও মৃত সন্তান প্রসবের বর্তমান পরিস্থিতি ও এর কারণ জানার জন্য জাতীয় সমীক্ষা বা জরিপ জরুরি হয়ে পড়েছে। মাতৃ, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে থেমে থাকা কাজগুলোকে সক্রিয় করতে হবে এবং স্বীকৃত নতুন সেবাগুলোকে আশু মাঠে নামাতে হবে।