
হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮৬ জন।
এ বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেছে ৪৩ জনের।
দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় ২০২৩ সালে।
দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪ হাজার ৩৪৫ জন। তবে এক জুন মাসেই এর চেয়ে বেশি মানুষ এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন; এ সংখ্যা ৫ হাজার ৮০৪। সরকারি হিসাব বলছে, এযাবৎকালের মধ্যে এক মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছে জুনে।
জুনে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে আর্দ্রতা ছিল বেশি। জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, এ কারণে ডেঙ্গুর রোগবাহী এডিস মশার বিস্তার বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ডেঙ্গুকে ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ ঘোষণার পক্ষে তাঁরা।
এ বছর ঢাকার চেয়ে সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এলাকাভিত্তিক ম্যাপিংয়ের দরকার বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই।
চলতি বছরে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১০ হাজার ৬৮২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ সোমবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮৬ জন। এ সময় একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেল ৪৩ জনের।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে ডেঙ্গুকে ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ ঘোষণার পক্ষে মত জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদদের।
এ পরিস্থিতি গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপনে দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বাসস জানায়, একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। মেয়াদ ছিল ৩০ জুন পর্যন্ত। নতুন প্রজ্ঞাপনে সময়সীমা আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে এনএস ফর ডেঙ্গু, আইজিজি ফর ডেঙ্গু ও আইজিএম ফর ডেঙ্গু পরীক্ষার সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ ফি ৫০ টাকা। আরেক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এনএস ফর ডেঙ্গু, আইজিজি ফর ডেঙ্গু ও আইজিএম ফর ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সিবিসি পরীক্ষা করাতে ফি দিতে হবে ৪০০ টাকা।
পাঁচ মাসের চেয়ে বেশি আক্রান্ত জুনে
গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৪ হাজার ৩৪৫ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আর এ সময় মৃত্যু হয় ২৩ জনের। তবে শুধু জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৮০৪ জন, যা আগের পাঁচ মাসের চেয়ে ১ হাজার ৪৫৯ জন বেশি। আর এ মাসে মারা গেছেন ২০ জন।
দেশে নতুন করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে জুনে। এরপর থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে।
এখন যেভাবে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, তাতে একে আর হেলাফেলা করা উচিত নয়। এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে একে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ঘোষণা করা দরকার।ডা. মুশতাক হোসেন, জনস্বাস্থ্যবিদ
এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ হয়। ওই বছরের জুন মাসে ১ হাজার ৮৮৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপর ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের জুনে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৭২, ৭৩৭ ও ৫ হাজার ৯৫৬ জন। ২০২৩ সালের জুন মাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল। এরপর এবারের জুন মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ হলো।
দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় ২০২৩ সালে। ওই বছর মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আগের ২৩ বছরে যতজন আক্রান্ত হয়েছিলেন, ওই বছর তার চেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ৭০৫ জন মারা যান।
‘আবহাওয়া ডেঙ্গুর অনুকূলে’
সাধারণত এক বছর সংক্রমণ বেশি হলে পরের বছর ততটা হয় না। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর সংক্রমণ কিছু্টা কম হয়েছে। কিন্তু এবার সংক্রমণে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। এবারের আবহাওয়া পরিস্থিতি ডেঙ্গুর অনুকূলে বলে মনে করছেন কীটতত্ত্ববিদেরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, জুন মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। বাতাসে আর্দ্রতা কখনো কখনো ৯০ শতাংশ থেকেছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি ডেঙ্গুর অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে ডেঙ্গুর নতুন ধরনের বিস্তার এবার সংক্রমণ পরিস্থিতি জটিল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ডেঙ্গুতে বড় সংক্রমণের সময় ২০২৩ সালে এবং গত বছরও ডেঙ্গুর চারটি ধরনের বা সেরোটাইপের মধ্যে ২–এর প্রাধান্য ছিল। এবার দেশজুড়ে কোনটি প্রাধান্য পাচ্ছে, তা জানা না গেলেও গত জুন মাসে আইইডিসিআর বরগুনায় জরিপ করে দেখেছে, সেখানে সেরোটাইপ–৩–এর বিস্তার ঘটছে।
নতুন কোনো ধরনের বিস্তার ঘটলে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা শুধু বাড়ে না, রোগীর পরিস্থিতিও নাজুক হয়। বরগুনায় এবারের সংক্রমণের পেছনে এটি বড় কারণ বলে মনে করেন তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ।
এলাকাভিত্তিক ম্যাপিং দরকার
এবার দেশের মোট সংক্রমণের প্রায় ২৫ শতাংশ হয়েছে দক্ষিণের জেলা বরগুনায়। এ জেলায় গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮৩৯ জন। আর দেশের মোট আক্রান্তের ৭৫ শতাংশই ঢাকার বাইরে। এর মধ্যে বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কক্সবাজারে সংক্রমণ অপেক্ষাকৃত বেশি। এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর অঞ্চলভিত্তিক ম্যাপিং দরকার বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন যেভাবে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, তাতে একে আর হেলাফেলা করা উচিত নয়। এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে একে ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ ঘোষণা করা দরকার।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের চেষ্টা যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে মুশতাক হোসেন বলেন, প্রয়োজনীয় বরাদ্দেরও সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এ জন্য সরকারকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচ) সহযোগিতা নেওয়া দরকার।
অঞ্চলভিত্তিক ম্যাপিংয়ের বিষয়টি আইইডিসিআর করবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক হালিমুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির বিষয়টি আপনারা ডব্লিউএইচওকে বলেন।’
অঞ্চলভিত্তিক ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে কোন অঞ্চলে সংক্রমণ কত, তার চিত্র পাওয়া যায়।
২১ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু বিষয়ে ১১ সদস্যের কারিগরি কমিটি গঠন করে। এ কমিটিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশারকে রাখা হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত তাঁকে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি বলে জানান এই কীটতত্ত্ববিদ।