বাংলাদেশের শতাব্দীপ্রাচীন টাঙ্গাইল শাড়ি বয়নশিল্পের ঐতিহ্য ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে ভারতের নয়াদিল্লির লালকেল্লায় এক অধিবেশনে ইউনেসকোর রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটিতে (আইসিএইচ) আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
নয়াদিল্লিতে চলমান ইউনেসকোর ইন্টারগভার্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের ২০তম অধিবেশনে বিশ্লেষণ শেষে ২০২৫ সালের চক্রে ইউনেসকোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যের এই বয়নশিল্পকে স্বীকৃতি জানানো হলো। নয়াদিল্লি থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা আসমা ফেরদৌসি।
আসমা ফেরদৌসি ছাড়াও এই অধিবেশনের বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেসকোয় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি খন্দকার মোহাম্মদ তালহা, দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ ও ফ্রান্সের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব মো. ওয়ালিদ বিন কাশেম।
বাংলাদেশের ষষ্ঠ আইসিএইচ উপাদান হিসেবে টাঙ্গাইল বয়নশিল্প চূড়ান্তভাবে তালিকাভুক্ত হলো। এর আগে ২০০৮ সালে বাউলসংগীত, ২০১৩ সালে ঐতিহ্যবাহী জামদানি বয়নশিল্প, ২০১৬ সালে পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, ২০১৭ সালে ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি বয়নশিল্প, ২০২৩ সালে রিকশা ও রিকশা পেইন্টিং তালিকাভুক্ত হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর এই স্বীকৃতি দেওয়া হতো। এর পর থেকে দুই বছর অন্তর এই স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আসমা ফেরদৌসি।
টাঙ্গাইলে প্রজন্মান্তরে হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বয়নের কৌশল শুধু কারুশিল্প নয়, বরং একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও। স্থানীয় কারিগরদের শ্রম, রং, নকশা, কৌশল আর সৃজনশীল নৈপুণ্যের সমন্বয়ে প্রতীয়মান হয় এর শিল্পরূপ। এই পরম্পরাগত বয়নশিল্পকে বাংলাদেশের বস্ত্রসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জামদানি ২০১৩ সালে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে প্রথম ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প হিসেবে ইউনেসকোর আইসিএইচের তালিকাভুক্তির পর ২০১৬ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের মর্যাদা পায়। এবার হয়েছে তার উল্টো। গত বছর টাঙ্গাইল শাড়ি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের মর্যাদা পাওয়ার পরই পেল এই স্বীকৃতি।
এখন পর্যন্ত ১৫০টি দেশের ৭৫০টি বহমান ঐতিহ্যকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ বছর ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় নিবন্ধনের জন্য মোট ৫৪টি আবেদন জমা দেওয়া হয়।
আইসিএইচ কী এবং ইউনেসকো কবে থেকে এটি স্বীকৃতি দিচ্ছে
ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো সেই সব জ্ঞান, দক্ষতা, প্রথা, আচরণ ও শিল্প-অনুশীলন যা কোনো সমাজ বা সম্প্রদায় পরম্পরাগতভাবে টিকিয়ে রাখে।
২০০৩ সালে ইউনেসকোর তত্ত্বাবধানে ‘কনভেনশন ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ নামে যাত্রা শুরু করে। এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোকে আইসিএইচ উপাদান শনাক্ত, রক্ষা ও প্রচারের জন্য বাধ্যবাধকতা দেয়। বাংলাদেশ ২০০৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে।
আইসিএইচ তালিকায় থাকা কেন গুরুত্বপূর্ণ
ইউনেসকোর আইসিএইচের তালিকার বিশেষত্ব হলো এটি কোনো দেশের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি ও মর্যাদা দেয়। তালিকাভুক্ত হলে কয়েকটি সুবিধা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। যেমন—১. বৈশ্বিক স্বীকৃতি: ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২. সম্প্রদায় ও শিল্পীদের মর্যাদা বৃদ্ধি: স্থানীয় কারিগর বা অনুশীলনকারীরা দক্ষতার মূল্যায়ন পান। ৩. সংরক্ষণ–প্রচেষ্টায় সহায়তা: রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুরক্ষাসংক্রান্ত প্রকল্প ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। ৪. অর্থনৈতিক সম্ভাবনা: পর্যটন, বাজার সম্প্রসারণ, ব্র্যান্ডিং ইত্যাদিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
যেভাবে হয় বাছাই ও তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া
সাধারণত যেকোনো উপাদান আইসিএইচ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়।
জাদুঘরের কিপার আসমা ফেরদৌসি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের নমিনেশন ফাইল জমা দিতে হয়। সেখানে সেই উপাদানের বর্ণনা, ঐতিহ্যবাহী ধারকদের সম্মতি, ভিডিও-ফটো ডকুমেন্টেশন, সংরক্ষণ পরিকল্পনা ইত্যাদি যুক্ত থাকে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই বাংলাদেশ গত বছরের মার্চে আবেদন করে। সেখানে পাঁচটি বিষয়ের ওপর সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হয়।
আবেদন জমা হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত মূল্যায়ন কমিটি মনোনয়ন বিশ্লেষণ করে সুপারিশ তৈরি করেন।
আন্তসরকারি কমিটির বার্ষিক অধিবেশনে কোনো উপাদানের উৎপাদন পদ্ধতির তালিকাভুক্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তালিকাভুক্তির পর ইউনেসকো সেটা প্রকাশ করে এবং সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে সংরক্ষণ-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়।
যেসব বিষয়ে স্বীকৃতি দেওয়া হয়
২০০৩ কনভেনশনের অধীনে তিন ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে—
রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট: এটাই সবচেয়ে পরিচিত। এটা মূলত লিভিং হেরিটেজের তালিকা। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কেবল এর অধীনেই আবেদন করেছে।
আর্জেন্ট সেফগার্ডিং লিস্ট: যেসব ঐতিহ্য বিলুপ্তির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা।
রেজিস্টার অব গুড সেফগার্ডিং প্র্যাকটিসেস: যেসব দেশ বা সম্প্রদায় সফলভাবে ঐতিহ্য রক্ষার উদাহরণ তৈরি করেছে, সেগুলোর তালিকা। এখানে একাধিক দেশ যৌথভাবে কোনো বিষয়ের জন্য আবেদন করতে পারে।
স্বীকৃতির সম্ভাব্য প্রভাব
তালিকাভুক্ত হলে স্থানীয় বয়নশিল্পীদের জন্য নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। আন্তর্জাতিক মানচিত্রে টাঙ্গাইল শাড়ির অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে; বাজার চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়বে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ঐতিহ্যগত বয়নশিল্প শেখার আগ্রহও বাড়তে পারে।
পাশাপাশি সরকারের জন্য সংরক্ষণমূলক নীতি প্রণয়ন, প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন ও ভৌগোলিক নির্দেশক সুরক্ষা জোরদার করার সুযোগ তৈরি হবে। অবশ্য ইউনেসকোর তালিকাভুক্তি কোনো অর্থনৈতিক সহায়তার নিশ্চয়তা নয়; বরং এটি সুযোগ ও সক্ষমতা তৈরির ভিত্তি।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মাসউদ ইমরান বলেন, ‘এই সুবিধার সুফলপ্রাপ্তি অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে ওই পণ্যের ট্রেডমার্ক দেওয়ার বিকল্প নেই। এটা করতে না পারলে আমরা আমাদের সুযোগ হারাব। জামদানির ক্ষেত্রে সেটা আমরা এখনো করে উঠতে পারিনি।’
আবেদনের জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন টাঙ্গাইল শাড়ি তাঁতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক নীল কমল বসাক। এই স্বীকৃতির খবর শুনে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এই স্বীকৃতি জরুরি ছিল। কারণ, টাঙ্গাইলের বয়নশিল্প প্রাচীন ঐতিহ্যেরই অংশ।