মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি

নতুন তালিকা বন্ধ ১৬ মাস

শিশুপুষ্টির ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে আরও দুই লাখ দরিদ্র মায়ের নতুন তালিকা করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।

দেশে শিশুপুষ্টির ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে দরিদ্র মায়েদের দুটি কর্মসূচিকে একীভূত করে আরও বড় পরিসরে চালুর ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। বলা হয়েছিল, এতে আরও দুই লাখ ভাতাভোগীকে যুক্ত করা হবে। তবে ১৬ মাস ধরে দরিদ্র মায়েদের সেই নতুন তালিকা বন্ধ রয়েছে।

গ্রামীণ এলাকায় ২০০৭-০৮ অর্থবছরে চালু ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ এবং শহর এলাকায় ২০১০-১১ অর্থবছরে চালু ‘কর্মজীবী মায়েদের জন্য ল্যাকটেটিং ভাতা’ কর্মসূচিকে মিলিয়ে ২০১৯–২০ অর্থবছরে নতুন করে ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’ চালু করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরে এই কর্মসূচিকে স্বীকৃতি দিয়ে এতে বরাদ্দ রেখেছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে এটি পরিচালিত হয়।

মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে—মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ এক হাজার দিন (৩ বছর) গর্ভবতী মা ও শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার ও কম ওজনের শিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনা। দেশে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় শিশুপুষ্টির এটিই সবচেয়ে বড় কর্মসূচি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো পুরোনো দুটি কর্মসূচির আওতায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাই শুধু ভাতা পাচ্ছেন।

জানতে চাইলে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, কোথাও তালিকা বন্ধ নেই। তিনি বিষয়টি নিয়ে কর্মসূচি পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

কর্মসূচি পরিচালক (মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি) রুবিনা গনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের জুলাই থেকে সারা দেশে নতুন তালিকা বন্ধ থাকার বিষয়টি সঠিক নয়। ২০১৯–২০ থেকে গত তিন অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়েনি।

যেসব ভাতাভোগীর মেয়াদ শেষ হয়েছিল, সেগুলো সংশ্লিষ্ট উপজেলায় প্রতিস্থাপন না করে অন্য ৩৩টি উপজেলায় তালিকা করে ভাতা দেওয়া হয়েছে। তবে পুরোনো কর্মসূচি তিনটির সমন্বয় ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যাচাই শেষ না হওয়ায় চলতি বছরের জুলাই থেকে আবেদনপ্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। নভেম্বর থেকে নতুন তালিকা তৈরির কাজ শুরু হবে।

ধীরগতি বড় কারণ

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, নতুন অর্থবছর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুসারে ভাতাভোগীদের এনআইডি যাচাই করতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে ভাতাদানকারী সংস্থাকে সমঝোতা স্মারক সই করতে হবে। এ জন্য ইসিকে বার্ষিক ফি পাঁচ লাখ টাকা ও নবায়ন ফি বাবদ এক লাখ টাকা দিতে হবে। এ ছাড়া প্রতি এনআইডি যাচাই বাবদ এক টাকা করে দিতে হবে। এ কাজগুলো এতই ধীরগতিতে হচ্ছে যে নতুন তালিকার কাজই বন্ধ হয়ে গেছে।

মাঠপর্যায়ে যা জানা গেল

বর্তমান তালিকা থেকে অনেক ভাতাভোগীর তিন বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সেখানে নতুন ভাতাভোগী প্রতিস্থাপন না করে ওই বরাদ্দ দিয়ে ৬৮টি উপজেলা এবং ঢাকা উত্তর ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনসহ ৪৪টি শহরে পরীক্ষামূলকভাবে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি চালু হয়।

রাজধানীর মধ্যে কেবল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কল্যাণপুর এলাকায় এই কর্মসূচি চালু হয়েছিল। তবে গত জুলাই থেকে সেখানেও নতুন তালিকা বন্ধ রয়েছে।

কল্যাণপুর এলাকার ১১ নম্বর রোডের ২৪ বছর বয়সী খাদিজা আক্তার ২৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গত মে মাসে ব্যাংক এশিয়ায় (এই ব্যাংকের মাধ্যমে ভাতা দেওয়া হয়) ভাতাভোগীর তালিকাভুক্ত হতে আবেদন জমা দেন। তালিকাভুক্ত হয়েছেন কি না, জানতে গত জুলাই ও আগস্টে দুবার ব্যাংকে যান। খাদিজা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, আপাতত কার্যক্রম বন্ধ আছে।

কল্যাণপুরের ১ নম্বর পোড়াবস্তি এলাকার বাসিন্দা শাহনাজ খাতুন (২২) দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিয়েছেন সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে। তিনিও অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আবেদন জমা দিলেও তালিকাভুক্ত হননি।

কল্যাণপুরের (ওয়ার্ড নম্বর ১১) স্থানীয় কাউন্সিলর কার্যালয়ের উদ্যোক্তা এয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাছে ৩০টির মতো আবেদন জমা পড়েছে। তবে নতুন তালিকাভুক্তির কোনো নির্দেশ পাননি।

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর রাজারগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল হাদী মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘তালিকা করার কোনো নির্দেশই পাইনি।’ এক বছরের বেশি সময় নতুন তালিকার কাজ বন্ধ বলে তিনি জানান।

নারায়ণগঞ্জের একটি ও সাতক্ষীরার দুটি উপজেলার মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা এবং একটি জেলার মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন, গত বছরের জুলাই থেকে নতুন তালিকার কাজ বন্ধ রয়েছে।

জানা গেছে, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর গত ১২ মে এক চিঠিতে কর্মসূচির জন্য উপজেলা পর্যায়ে অবহিতকরণ সভার করতে ৬০ হাজার টাকা বাজেট বরাদ্দের কথা জানায়। তবে এই সভা কবে করতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়নি।

নেতিবাচক প্রভাব পড়বে

মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচিসহ শিশুর সামাজিক সুরক্ষাবিষয়ক সাম্প্রতিক এক গবেষণায় যুক্ত ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, করোনার কারণে শিশুপুষ্টির বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ সময় কর্মসূচিটিতে নতুন ভাতাভোগী যুক্ত না হওয়ায় অনেকেই তালিকার বাইরে থেকে গেল। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই ভাতাভোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ানো প্রয়োজন।