সন্ত্রাসী হামলায় ভস্মীভূত প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয়
সন্ত্রাসী হামলায় ভস্মীভূত প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয়

আক্রান্ত প্রথম আলোর প্রতি সংহতি

‘হাত দিয়ে বলো সূর্যের আলো রুধিতে পারে কি কেউ?’

সন্ত্রাসী আক্রমণের কারণে এক দিন বন্ধ থাকার পর প্রথম আলো পুনরায় প্রকাশিত হলে যেন হাঁপ ছাড়লেন মনজিলা মিতু। আজ শনিবার তিনি প্রথম আলো হাতে পাওয়ার পর ফেসবুকে লিখলেন, ‘প্রথম আলো ছাড়া অন্য পত্রিকা পড়ে শান্তি পাই না। এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। ছেলেও সকালে উঠে আগে পত্রিকা খোঁজে। গতকাল থেকে জিজ্ঞাসা করছে—কবে পত্রিকা বের হবে? আজ সকালে পত্রিকা দেখে সে অনেক খুশি।’

শনিবার প্রথম আলো হাতে পেয়ে একই ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করে রাফসান আর আহমেদ নামে একজন লেখেন—‘হাত দিয়ে বলো সূর্যের আলো রুধিতে পারে কি কেউ? আমাদের মেরে থামানো যাবে না গণজোয়ারের ঢেউ।’

আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া প্রথম আলোর কার্যালয়ের দিকে ইঙ্গিত করে আরেকজন মন্তব্য করেন, ‘জ্বলে পুড়ে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম আলোর অগুনতি পাঠকের মনে যেমন উদ্বেগ ছড়িয়েছিল, তেমনি এর স্পর্ধিত ফিরে আসা কোটি কোটি পাঠকের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। এই মানুষদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন তাদের অনুভূতি, সংহতি জানিয়েছেন তাদের প্রিয় সংবাদপত্রের প্রতি।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনায় আজ শনিবার প্রকাশিত ডেইলি টাইমস অব বাংলাদেশের প্রথম পাতার ওপরের অংশ ফাঁকা রাখা হয়। সেখানে শুধু প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার লেখা ছিল। ডেইলি টাইমস অব বাংলাদেশের এমন ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে

গুলিবিদ্ধ জুলাই অভ্যুত্থানের মুখ, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদি গত বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর ক্ষোভ–বিক্ষোভ চলার মধ্যে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়। হামলাকারীরা ভাঙচুরের পর আগুনে জ্বালিয়ে দেয় গোটা ভবন। কয়েক শ গজ দূরে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের কার্যালয়েও একই সময় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকার বাইরে কুষ্টিয়া, খুলনা, সিলেটসহ আরও কয়েকটি স্থানে প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলা হয়।

প্রথম আলো অফিসের ভেতরে থাকা কাগজপত্র বাইরে বের করে জড়ো করে তাতে আগুন ধরানো হয়

ওসমান হাদির দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে স্বার্থান্বেষী একটি মহল এই সন্ত্রাসী আক্রমণ চালায় বলে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ মনে করছে। এই ঘটনায় দেশ–বিদেশ থেকে নিন্দা–প্রতিবাদের ঝড় বইছে।

সংবাদকর্মীরা প্রাণ বাঁচাতে পারলেও কাজ শেষ করতে না পারায় শুক্রবার প্রথম আলো প্রকাশ করা যায়নি, অনলাইনে সংবাদ প্রকাশও বন্ধ করেত হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে প্রকাশ শুরুর পর এই প্রথম প্রথম এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো যে প্রথম আলো প্রকাশ করা যায়নি। তবে ‘সত্যই সাহস’ এই স্লোগানে ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে আসা প্রথম আলো একদিন পরই ফিরে আসে পাঠকের দুয়ারে।

হামলার পরদিন প্রথম আলো প্রকাশিত না হওয়ার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পাঠকের পাশাপাশি সাংবাদিক, লেখক, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নিন্দা, সংহতি ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

লেখক কবির আহমেদ চৌধুরী ফেসবুকে লেখেন, ‘যেকোনো বড় ঘটনার পর প্রথম আলো পত্রিকা আট কলামজুড়ে যে হেডলাইন করে, এটা সব সময় আকর্ষণীয়। দুরন্ত কাব্যিক ও ঐতিহাসিক হয় সে শিরোনাম। হয় রেফারেন্স। হাদির (ওসমান হাদি) দুর্ভাগ্য, সে প্রথম আলো পত্রিকার সেই ব্যানার হেডলাইন থেকে বঞ্চিত হলো।’

প্রথম আলোর ওপর হামলা নিয়ে কবির আহমেদ চৌধুরী লেখেন, ‘খাণ্ডবদাহনের সেই রাত, আমাদের দেখা অন্যতম করুণ রাত। আমাদের সতত সমবেদনা সকল ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি।’

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরীফুল হাসান ফেসবুকে লেখেন, ‘শত আক্রমণ বাধার পরেও বারবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াক ডেইলি স্টার, প্রথম আলো। মাথা উঁচু করে দাঁড়াক সাংবাদিকতা! মাথা উঁচু করে দাঁড়াক প্রিয় বাংলাদেশ!’

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরজু আহমেদ লেখেন, ‘প্রথম আলোর সামনে যখন আগে একবার বিক্ষোভ হয়েছিল, তখন হাদি বলেছিলেন, “প্রথম আলোর সামনে যারা দাঁড়িয়েছে, আমরা তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি? আমরা বলি, না! আপনি পারলে বিকল্প আরও দশটা প্রথম আলো তৈরি করেন।” তার অফিসের সামনে আপনার কাজটা কী? হাদি প্রথম আলো অফিসের সামনে বিক্ষোভে দাঁড়ানোর বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর লাশের নাম নিয়া তাতে আগুন দেওয়া হলো। এতে এক দিন ছাপা বন্ধ থাকল। কিছু সময় অনলাইনও বন্ধ থাকবে। এর বাইরে লাভ হলো কতখানি? বরং এতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম আলোর প্রভাব ও হায়াত আরও অন্তত কয়েক যুগ বেড়ে গেছে।’

দ্য ডিসেন্টের সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির লেখেন, ‘হাদির মৃত্যুকে পুঁজি করে যারা প্রথম আলো ডেইলি স্টারে হামলা করতে গেছে, ওরা যে হাদির বন্ধু না, অনুসারী না, এটা স্পষ্ট। গণতন্ত্রবিরোধীরা হাদির লাশকে ব্যবহার করে নিজেদের কদর্য চেহারা প্রকাশ করেছে গতকাল।’

প্রথম আলো, ডেইলি স্টারে হামলা যে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করল, তা উঠে আসে ব্লুমবার্গের সাবেক রিপোর্টার নাজমুল আহসানের কথায়। তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘এক সপ্তাহও হয়নি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি ফর গুড। সাংবাদিকতা করতে। নট দ্য বেস্ট টাইমিং, তাই না? আমার সাবেক কলিগ, ফ্রেন্ডস, আমার প্রফেসররা পর্যন্ত কালকে টেক্সট করে খবর নিয়েছে। যেহেতু সাংবাদিক কম্যুনিটিটা ছোট, ফলে বিশ্বের কোথায় কী ঘটে, সবাই আগে পরে জেনে যায়। আসার সময় সবাইকে বুঝ দিয়ে এসেছিলাম যে দেশে অন্তত কিছু কথা বলা যাবে এখন সরকারি গেঞ্জাম ছাড়াই। কী যে মাথা হেইট হয়েছিল কালকে তাদেরকে জবাব দেওয়ার সময়। কী বলব! এমন হিউমিলিয়েশনের অনুভূতি মানুষের জীবনে খুব কম আসে।’

গুজব আর অপতথ্য বিস্তারের এই সময়ে প্রথম আলোর ওপর ভরসা যে কত, তা উঠে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্নজনের লেখায়।

মেহেদি হাসান নামে একজন ফেসবুকে লেখেন, ‘২৪শের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় যখন নেট বন্ধ ছিল, টিভি চ্যানেলগুলো তেমন কিছু একটা দেখাচ্ছিল না, তখন অনেক খুঁজে Prothom Alo , The Daily Star  পত্রিকা পড়তাম, অন্য নিউজ পোর্টালগুলোর ওপর তেমন একটা ট্রাস্ট ছিল না যে কিছুটা সঠিক নিউজ দিতে পারবে। ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোতে যারা হামলা করেছে, তারা দেশের শত্রু, এ জাতির শত্রু, এ হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’

সারওয়ার আহমেদ মিয়াজি নামে একজন লেখেন, ‘যদি সক্ষমতা থাকে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের বিকল্প তৈরি করে মোকাবিলা করেন। সাহসী হাদির লাশ নিয়ে গতকাল যারা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছেন আপনারা হাদির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারসহ সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’

প্রথম আলোর নিয়মিত পাঠক যাঁরা, তাঁদের জন্য শুক্রবার সকালটা ছিল বঞ্চনার এক অনুভূতি। কারণ, প্রিয় সংবাদপত্রটির পরিবর্তে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য বিকল্প বেছে নিতে হয়েছিল তাঁদের।

লায়লা নাসরিন নিতু নামে একজন লেখেন, ‘গত ২০–২২ বছর ধরে রেগুলার পড়ি। যতদিন থাকবে, পড়ব। আচ্ছা ওরা কি এই (প্রথম আলো) পত্রিকা পড়ে? কোনোদিন Daily Star–এর একটা কলাম পড়েছে?’

‘পত্রিকায় এসেছে, কিছু দো-পেয়ে, non-functional প্রাণী দেখলাম হুমকি দিচ্ছে—“এরপর প্রকাশ হলে সাংবাদিকসহ পুড়িয়ে দিব।” কিন্তু পাঠকদের কী করবে? কত মানুষ মারবে? মারতে মারতে টায়ার্ড হয়ে যাবে!’ লিখেছেন লায়লা নাসরিন।

রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রথম আলোয় হামলার নিন্দা–প্রতিবাদ আসে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা প্রথম আলো কার্যালয়ে এসে সংহতিও প্রকাশ করেন। এর বাইরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা প্রতিক্রিয়া জানান। সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো, বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও জানায় তীব্র নিন্দা।

এক দিন বাদে প্রথম আলো প্রকাশিত হওয়াকে অশুভের বিপরীতে শুভশক্তির জয় হিসেবেই দেখছেন অনেকে। লেখক আরিফ রহমান লেখেন, ‘আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে প্রিয় প্রথম আলো—এটাই শুভশক্তির সম্মিলিত প্রকাশ।’ প্রথম আলোর এই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশংসা করে কার্টুনিস্ট আহমদ কবীর কিশোর লেখেন, ‘প্রথম আলো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওয়েলকামব্যাক।’

আগুনে পুড়ে এই হাল এখন প্রথম আলো কার্যালয়ের

মোহাম্মদ রুবেল রানা নামে একজন ফেসবুকে লেখেন, ‘দেশের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা প্রথম আলো। হামলায় আক্রান্ত পত্রিকাটি একদিন বন্ধ থাকার পর আবারও প্রকাশিত হয়। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশে ২৭ বছর সাংবাদিকতা করে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের জন্য শুভকামনা।’

প্রথম আলোর এই ফিরে আসাকে প্রথম আলোর অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখছেন অনেকে; তাঁদেরই একজন শামসুজ্জামান চৌধুরী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ভস্ম আর ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো আবার ফিরে এসেছে প্রিয় প্রথম আলো। এই ফিরে আসাই প্রমাণ করে শক্তি, সাহস আর অদম্য প্রত্যয়।’