লেখক-সাংবাদিক মনজুরুল হক সম্প্রতি জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, জাপানের ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে তাঁর অর্জন বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ককে দৃঢ় করেছে। ৩৩ বছর ধরে জাপানে থেকেও তিনি সেদেশের নাগরিকত্ব নেননি। আত্মপরিচয় ও বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম দরদের থেকে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

লেখক-সাংবাদিক মনজুরুল হকের নামের সঙ্গে আমার পরিচয় কয়েক দশক আগে। পরিচয়ের সূত্র ছিল ভোরের কাগজ-প্রথম আলোয় প্রকাশিত তাঁর চমৎকার সব লেখা।
সরাসরি পরিচয়ের সূত্রপাত প্রায় দেড় দশক আগে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার জাপানে আসার পর এক জাপানি পরিচালকের বাংলাদেশে নির্মিত এক চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে।
জাপানে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন ও মনজু ভাই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন। প্রদর্শনী–পরবর্তী আলোচনা থেকে আলাপের সূত্রপাত। এ সময় দুজনের অনেক অভিন্ন বন্ধুর সন্ধান মেলে, দর্শনের ক্ষেত্রেও পাওয়া যায় সাদৃশ্য।
আলাপের মধ্যেই জানলাম, আমরা দুজনেই দুটি ভিন্ন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে যে সংগঠনটির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। এ পরিচয় আরও পোক্ত হয় ষাটের দশকের ঘটনাবলি নিয়ে ইংরেজি ভাষায় লেখা মনজু ভাইয়ের একটি আত্মজীবনীমূলক বইয়ের অনবদ্য পাণ্ডুলিপি পাঠ করে।
বহু বছর পর পাণ্ডুলিপিটি বছর দুয়েক আগে ‘স্টোরি অব মাই টাইম’ শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে কসমস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে। প্রথম দিকে আমাদের সাক্ষাতের নিয়মিত স্থান ছিল জাপানের অন্যতম সম্মানজনক একটি প্রতিষ্ঠান ‘ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব অব জাপান’ বা ‘এফসিসিজে’র টোকিওর কার্যালয়। সারা বিশ্বের বিখ্যাত সব সংবাদ সংস্থার টোকিও প্রতিনিধিদের এই সংগঠনের একসময় নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন মনজু ভাই। তাঁরই আমন্ত্রণে এ ক্লাবে প্রবেশের প্রথম দিনেই বেশ চমকে উঠেছিলাম।
প্রবেশমুখেই দেয়ালে ঝোলানো অনেকগুলো ছবি। মোহাম্মদ আলী, রোনাল্ড রিগ্যান, জ্যাক শিরাক, পেলে, দালাইলামা, মাহাতির মোহাম্মদ, ম্যারাডোনাসহ এ ক্লাবে পদার্পণ করা বিশ্বের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি সেখানে। তাঁদের মধ্যে দেখা যায় মনজু ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল এক ছবি, বাংলাদেশেরই আরেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি।
পরে জানলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে মার্কিন সাংবাদিকদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাবের নিয়মই হচ্ছে এর নির্বাচিত প্রেসিডেন্টদের ছবি দেয়ালে স্থায়ীভাবে লাগিয়ে রাখা এবং তাঁদের মেয়াদে ক্লাবের বিশিষ্ট অতিথিদের কারও না কারও সঙ্গে তোলা একটি ছবির স্থান হয় সেখানে।
মনজু ভাইয়ের সঙ্গে সরাসরি পরিচয়ের শুরুটা ছিল এমন। এরপর এত বছর ধরে তাঁর সঙ্গে আমার আলোকিত সংযোগ। সব্যসাচী মনজু ভাইয়ের অন্তহীন সৃষ্টিশীলতা অবলোকনের সুবাদে প্রাথমিক সেই বিস্ময়ের সীমা ক্রমশ বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হয়েছে। এখানে এটি বললেও অত্যুক্তি হবে না যে অস্ট্রেলিয়া থেকে গবেষণার জন্য মাত্র দুই বছরের জন্য এসে জাপানে এত দিন আমার থেকে যাওয়ার পেছনেও মনজু ভাইয়ের রয়েছে একটি বড় উৎসাহ বা ভূমিকা।
মনজু ভাইয়ের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ও আলাপ থেকে জানা যায়, তাঁর জন্ম সেই ১৯৫২ সালে সদ্য স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায়, যে শহরের গায়ে লেগে ছিল তখনো মফস্সলের ছাপ। তাই বলা যায়, মনজু ভাই কিংবা তাঁর প্রজন্মের বেড়ে ওঠা মূলত ঢাকা শহরের হাত ধরেই। অন্যদিকে তাঁদের কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দিকে এগিয়ে চলার কাল তো আসলে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামের পরিণত হয়ে ওঠারই সময়, যে লড়াই-সংগ্রামে মনজু ভাইয়ের ছিল সক্রিয় সাহসী ভূমিকা। ল্যাবরেটরি স্কুল-ঢাকা কলেজ-ছাত্র আন্দোলন—উত্তাল আর উদ্দাম কেটেছে দিনগুলো।
পরে মনুজ ভাই যোগ দেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা দলের অংশ হয়ে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকালে পায়ে হেঁটে রাইফেল হাতে প্রবেশ করেন ঢাকায়। এ সময়গুলোতে তাঁর বন্ধুদের মধ্যে একজনের কথা বারবার বলেন তিনি। খান মোহাম্মদ ফারাবি—অকালে নিভে যাওয়া সাম্যবাদের স্বপ্নে বিভোর উদীয়মান এক চিন্তাশীল লেখক ছিলেন যিনি, যাঁর সঙ্গে তিনি একত্রে সম্পাদনা করেছিলেন ‘জয়ধ্বনি’সহ আরও কয়েকটি সৃজনশীল সংকলন। তাঁর স্মৃতিচারণায় আরও থাকেন লেখক-সাংবাদিক মতিউর রহমান ও আবুল হাসনাতের কথা, যাঁদের হাত ধরে সে মসয় তাঁর লেখালেখিতে আগমন।
যুদ্ধফেরত মনজু ভাই সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশগ্রহণের শপথ নেন। তবে এরপর দেশে তাঁর খুব বেশি দিন থাকা হয়নি। চলে যান বৃত্তি নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে, যেখানে তিনি দীর্ঘ আট বছরের পড়াশোনা শেষে সাংবাদিকতায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। তবে সেখানেও অব্যাহত থাকে লেখালেখির চর্চা। কিছুদিন কাজ করেন ‘সোভিয়েত নারী’ ম্যাগাজিনে।
বিখ্যাত মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নকালীন প্রেম এবং পরে পরিণয় জাপানি তরুণী ইউমিকোর সঙ্গে। পড়াশোনার পাশাপাশি সোভিয়েত সমাজকে ভেতর থেকে দেখেছেন এবং মুখোমুখি হয়েছেন নিজেকে আরও পরিণত ও ঋদ্ধ করার মতো নানা অভিজ্ঞতার। এই রোমাঞ্চকর জীবনের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় বেঙ্গল প্রকাশনী থেকে বের হওয়া তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘আমার প্রবাস জীবন: সোভিয়েত পর্ব’তে।
স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফেরেন। প্রায় ১০ বছর জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্রের কাজের পাশাপাশি লেখালেখি করেছেন নিয়মিত দৈনিক সংবাদের সাহিত্যপাতায়। ১৯৯০ সালে চলে যান লন্ডনে বিবিসির বাংলা বিভাগে প্রযোজকের দায়িত্ব নিয়ে। প্রায় চার বছরের বিলেত থাকাকালীন তিনি সম্পন্ন করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানের গণমাধ্যম ও রাজনীতি নিয়ে আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি।
গবেষণার অংশ হিসেবে লন্ডনের ব্রিটিশ ইন্ডিয়া লাইব্রেরিতে বিস্মরণের গহ্বর থেকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আনেন হরিপ্রভা তাকেদা নামের এক বাঙালি নারীর এক দুর্লভ ডায়েরি। তৎকালীন পূর্ব বাংলার ঢাকা নিবাসী সেই নারী রবীন্দ্রনাথেরও আগে ১৯১২ সালে জাপান সফর করেছিলেন তাঁর জাপানি স্বামী উয়েমন তাকেদার হাত ধরে।
সে সময়ের জাপান অবলোকন নিয়ে হরিপ্রভা তাকেদা লিখে গেছেন এক অনবদ্য বিবরণ। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘জাপান যাত্রী’র আগে এটিই একমাত্র বাংলায় রচিত জাপান–সম্পর্কিত বই। এই কাহিনি নিয়ে পরবর্তী সময়ে গুণী নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলসহ অন্যরা নির্মাণ করেছেন একাধিক চলচ্চিত্র, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রচিত হয়েছে গবেষণাপত্র।
নিজের প্রবন্ধসহ হরিপ্রভার জাপান দর্শনের এই জার্নাল বই আকারে প্রকাশ করে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ বা পূর্ব বাংলার সংযোগের একটি নতুন ডিসকোর্সই যেন চালু করেন মনজু ভাই। কারণ, এর আগপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে এই সংযোগের সূত্র ছিল মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক, বিশেষ করে রাসবিহারী বসু, নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু এবং বিচারপতি রাধাবিনোদ পালেই যেন ঘুরপাক খেয়েছে জাপান-বাংলার সম্পর্কের শিকড়।
মনজুরুল হক এক পর্যায়ে নিজেই চলে এলেন সূর্যোদয়ের দেশে। আগে পারিবারিক কারণে জাপানে এলেও এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন ১৯৯৪ সালে। এরপর একে একে অসামান্য সব অর্জনের ইতিহাস। ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাবের কথা তো বললাম। এর বাইরেও রয়েছে নানা ক্ষেত্রে মনজু ভাইয়ের সফল বিচরণ। তিনি টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে প্রায় দুই যুগ ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। পড়িয়েছেন জাপানের রাজনীতি, গণমাধ্যম, সমকালীন জাপানসহ অন্যান্য বিষয়ে। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু হলে শুরু থেকেই তাতে যুক্ত হন তিনি এবং অবসর গ্রহণের আগপর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন।
এর পাশাপাশি কাজ করেছেন জাপানের গণসম্প্রচার কেন্দ্র এনএইচকে ওয়ার্ল্ডের বাংলা বিভাগে, যে কাজ তিনি এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম আলোর টোকিও প্রতিনিধির দায়িত্ব তো রয়েছেই। এই তালিকা থেকেই বোঝা যায়, কতটা কর্মঠ ও সব্যসাচী ব্যক্তিত্ব তিনি।
মনজু ভাইয়ের একটি অসাধারণ অর্জনের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি সেই বিরল মানুষদের একজন, যাঁরা জাপানের সম্রাটের আমন্ত্রণে তাঁর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ ও আলাপের সুযোগ পেয়েছেন। জাপানি সমাজে এ বড় সম্মানের বিষয়, সাধারণত অন্য কোনো দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রদূত ব্যতিরেকে সম্রাটের এত কাছে যাওয়ার সুযোগ খুব বিরল। এফসিসিজের সভাপতি হিসেবে তাঁর এ সুযোগ মেলে।
সাংবাদিক হিসেবে তিনি চষে বেড়িয়েছেন সারা জাপান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম, দুর্ঘটনাকবলিত ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন ঘাঁটি। এর পাশাপাশি জাপানের শিল্প-সংস্কৃতির জগতেও তাঁর নিয়মিত বিচরণ। একটি ক্ষেত্র উল্লেখ না করলেই নয়, আর তা হচ্ছে জাপানের চলচ্চিত্র উৎসবগুলো, যেখানে তিনি রয়েছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে বেশ শ্রদ্ধার আসনে। একবার টোকিও চলচ্চিত্র উৎসবের এক নারী কর্মকর্তা তো আমাকে বলেই ফেললেন, তাঁর মতো চিন্তাশীল, স্মার্ট মানুষ সত্যিই বিরল।
মনজু ভাইয়ের আরেকটি বড় বা মূল পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন অত্যন্ত গুণী লেখক। পাঠকদের নিশ্চয়ই পড়ার সুযোগ হয়েছে, টোকিও থেকে প্রথম আলোয় নিয়মিত বিরতিতে লেখা তাঁর ভিন্নধর্মী কলামগুলো। মূলত জাপান ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে লেখা এই নিবন্ধগুলোতে রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, ক্রীড়া থেকে জাপানের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, উৎসব থেকে বিপর্যয়—এ রকম বিচিত্র বিষয়ের দেখা মেলে।
শুধু হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ও তার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা নিয়ে মনজু ভাইয়ের লেখা নির্বাচিত বেশ কিছু কলাম নিয়ে প্রথমা প্রকাশন প্রকাশ করেছে ‘হিরোশিমা নাগাসাকির কথা’ নামের একটি গ্রন্থ। তাঁর বাড়িতে জাপান–সম্পর্কিত বইয়ের সারি যেন একটি ছোটখাটো লাইব্রেরি। অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপ নিয়েও তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী। তার কিছুটা হদিস মেলে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে লেখা সাম্প্রতিক কলামগুলোতে।
মনজু ভাই অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বিদেশি কবিতা। এর মধ্যে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে পোল্যান্ড থেকে আলবেনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কবিদের কবিতা সংকলন ‘প্রতারিত পৃথিবীর দিকে মেলে ধরা গোলাপ’। এর পাশাপাশি রয়েছে বিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি কবি গিয়োম এপোলিনেরের কবিতা নিয়ে বই ‘অশ্রুভেজা চোখে করাঘাত’ এবং আনা আখমাতভা, আর্সেনি তারকোভস্কিসহ আটজন রুশ কবির কবিতা নিয়ে ‘কবির কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই’। সব কটি বইয়েই কবিতার আগে যোগ হয়েছে ঋদ্ধ ভূমিকা, যাতে উঠে এসেছে কবিতাগুলো লেখার ঐতিহাসিক-সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট।
হায়দার আলী খানের সঙ্গে অনুবাদ করেছেন মধ্যযুগীয় জাপানি হাইকু কবি বাশোর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অকুর সরু পথ’। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ল্যাটিন বিপ্লবী চে গুয়েভারাকে নিয়ে ‘চে: বন্দুকের পাশে কবিতা’। চের বিপ্লবী জীবন ও রাজনীতির পাশাপাশি এতে স্থান পেয়েছে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ‘সবুজ ডায়রি’ থেকে নির্বাচিত কিছু অনূদিত কবিতা এবং চের চিঠিসহ অন্যান্য লেখা।
সম্পাদনার তালিকায় আরও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বই ‘রবীন্দ্রনাথের জাপান জাপানের রবীন্দ্রনাথ’। জাপান ও বাংলাদেশ দুই দেশেরই লেখক-পণ্ডিতদের নাম এই বইয়ের সূচিতে রয়েছে। একাধিকবার জাপান ভ্রমণকারী রবীন্দ্রনাথের প্রাচ্যের এই দেশকে ঘিরে কাব্যিক-দার্শনিক অবলোকন এবং অন্যদিকে জাপানে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক ও সমকালীন মূল্যায়নের দ্বান্দিক উপস্থাপনা এতে অন্তর্ভুক্ত।
উল্লিখিত ‘স্টোরি অব মাই টাইম’ ২০২২ সালে প্রকাশিত তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক প্রকাশনা। চমৎকার অলংকরণ, মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ে প্রকাশিত বইটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত, বিশেষ করে ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলনের এক জ্বলজ্বলে দলিল। যে সাবলীল ইংরেজিতে তিনি তাঁর জীবন ও বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে এতে তুলে ধরেছেন, তা তুলনাহীন। অর্থনীতিবিদ হায়দায় আলী খান যেমন বলেছেন, এই লেখা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্যও অনুপ্রেরণার হতে পারে।
আমার ব্যক্তিগত পাঠ, যার মাধ্যমে মনজু ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা, আমাকে এই উপলব্ধি দেয় যে বহুকাল পর যেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অতিগুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে অভিনব আঙ্গিক ও উপস্থাপনায় একটি বই রচিত হলো, যার মাধ্যমে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস বিশ্বের পাঠকদের কাছে স্বমহিমায় উপস্থাপিত হওয়ার সুযোগ পেল। বাঙালির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে রচিত এই আখ্যানে, একজন ব্যক্তি, একটি শহর ও একটি জাতি—ভিন্ন তিনটি চরিত্রের বিকাশ ঘটে পাশাপাশি এবং নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পরিশেষে তা একটি বিন্দুতে মিলিত হয়ে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছায়। আর সেই বইয়ে তাঁর কলম থেমে যায় ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চে।
তবে বইটির গুণমুগ্ধ পাঠক এবং তৎকালীন অনেক সতীর্থ-সহযোদ্ধার ক্রমাগত অনুরোধে লেখক শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে তাঁর সচক্ষে অবলোকন করা নানা ঘটনা ও মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবলীল ইংরেজিতে রচনা করেছেন আরও একটি বই। মনোমুগ্ধকর ডিজাইন ও আদলে ‘আ টাইম টু ড্রিম অ্যান্ড আ টাইম অব ডিসপেয়ার’ নামে এ বছরের শুরুতে বইটি প্রকাশিত হয়েছে কসমস পাবলিশার্স থেকে। বাংলাদেশে সংঘটিত ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা নিয়ে সাম্প্রতিক বাস্তবতায় সৃষ্ট বিকৃতি-বিভ্রমের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে এটি যেন তাঁর সাহিত্যিক দায়মোচন। বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এই দুটি বই নিয়েই প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে টোকিওর এফসিসিজেতে।
সৃষ্টিশীল লেখালেখির ক্ষেত্রে একই সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজির এই দখল বেশ বিরল। প্রথম আলোর পাশাপাশি ডেইলি স্টার ও ঢাকা কুরিয়ারে লেখা তাঁর কলামগুলো যাঁদের পড়ার সুযোগ হয়েছে, তাঁদের নিশ্চয়ই কিছুটা জানা আছে এ সম্পর্কে।
এত কিছুর বাইরে ২০২১ সাল থেকে তিন বছর ধরে মনজু ভাই নিয়মিত কলাম লিখছেন জাপানের সবচেয়ে বড় দৈনিকগুলোর একটি ‘মাইনিচি সিম্বুন’তে। পত্রিকাটির মুদ্রিত সার্কুলেশন দৈনিক প্রায় ৩০ লাখ। বিশ্বের মাত্র পাঁচটি দেশের সাংবাদিককে নিয়মিত একটি বিশেষ কলাম লেখার অনুরোধ জানায় কর্তৃপক্ষ। আমেরিকা, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে এতে মনজু ভাইয়ের নামও রয়েছে। এ যেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতারই এক অনন্য স্বীকৃতি।
জাপান কিংবা বাংলাদেশ—যেদিক থেকেই দেখি না কেন, মনজুরুল হক যেন দুই দেশের সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ–সংশ্লিষ্ট জাপানি শীর্ষ কূটনীতিকদের থেকে শুরু করে অন্য বিশিষ্ট জাপানিরাও নানা অনুষ্ঠান ও আলাপে সেই স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। ব্যক্তিগত আলাপে তিনি আধুনিক, প্রগতিবাদী ও নিতান্তই মাটির মানুষ, যদিও নীতি কিংবা আদর্শের জায়গায় কখনো এতটুকু দেন না ছাড়।
বাংলাদেশের প্রতি মনজুরুল হকের যে অকৃত্রিম দরদ, তার একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যাক। জাপানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া অনেক বাংলাদেশি একপর্যায়ে জাপানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এত বছর জাপানি স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে জাপানে বসবাসের পরও তিনি কেন জাপানি নাগরিকত্ব নিলেন না, এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা একটি দেশ, একটি মানচিত্র, একটি নিজস্ব পরিচয়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। কোনো সনদ বা সুবিধা নেওয়ার জন্য নয়। আমি যদি জাপানের নাগরিকত্ব নিই, তাহলে তো আত্মপরিচয়ের জন্য আমাদের সমস্ত ত্যাগ-লড়াইই বৃথা হয়ে যাবে।’
পাঠকদের বলে রাখি, জাপানে দ্বৈত নাগরিকত্বের চল নেই। কেউ জাপানি নাগরিক হতে চাইলে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ দেশের নাগরিকত্ব বিসর্জন দিতে হবে। মনজু ভাই যে সেই ব্যক্তি নন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে জাপানি নাগরিক না হয়েও জাপানে বাংলাদেশ মানেই যেন একজন মনজুরুল হক, যিনি হাইকু কবি বাশোর সূত্র ধরে বললে, নিত্যই যেন ওঠে চলেছেন সুউচ্চ চূড়ায় সরু পথ বেয়ে যতটা সংকুলই হোক না কেন সে যাত্রা। সঙ্গে বহন করে চলেছেন প্রিয় স্বদেশকেও।
এরই মধ্যে মনজুরুল হক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে জাপানের কাছ থেকেই। গত কয়েক দশকে সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে জাপান ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকেশি ইওয়াইয়ার কাছ থেকে বিশেষ প্রশংসা সনদ তিনি পেয়েছেন ৫ সেপ্টেম্বর। এটি ছিল জাপানে কর্মরত বিদেশি কোনো সাংবাদিক হিসেবে প্রথমবারের মতো জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ সম্মাননা লাভ।
বিশ্বের প্রায় সব প্রধান সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি থাকা জাপানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের এই সম্মাননা প্রাপ্তি বিরল এক অর্জন। ব্যক্তি মনজু ভাইয়ের জন্যই শুধু নয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্যও এটি অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক। জীবনের এ পর্যায়ে এসে নিশ্চয়ই এ রকম আরও স্বীকৃতি অপেক্ষা করছে সাংবাদিক মনজুরুল হকের জন্য, শুধু বিদেশ থেকে নয়, স্বদেশ থেকেও, যাকে ধারণ করে চলেছেন তিনি আজীবন মনন ও লেখায় সমভাবে।
টোকিওতে কর্মরত বিদেশি সাংবাদিকেরাও উদ্দীপিত মনজুরুল হকের এই অর্জনে। ২৭ সেপ্টেম্বর সেই উপলক্ষে এফসিসিজেতে আয়োজন করা হয় বিশেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের। ব্যক্তি মনজুরুল হক যে তাঁর তিন দশকের সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে জাপান ও বাংলাদেশের সেতুবন্ধ হয়ে উঠেছেন, সেই উচ্চারণই ধ্বনিত হলো সেখানে উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে। বাস্তবিকই মনজু ভাই যেন তাঁর শাণিত ব্যক্তিত্ব ও লেখা দিয়ে স্বীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্রমশ হয়ে উঠেছেন টোকিওতে জ্বলজ্বলে এক বাংলাদেশের মুখ। তাঁর প্রতি রইল অফুরান শুভেচ্ছা।
লেখক: মঈনুল শাওন: সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার ও শিক্ষক, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ