ইনাম আল হকের (বাঁয়ে) সঙ্গে একান্তে লেখক
ইনাম আল হকের (বাঁয়ে) সঙ্গে একান্তে লেখক

শুভ জন্মদিন

আমার শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষক ইনাম আল হক

ইনাম আল হক এবং আমার একমাত্র সন্তান, শাহরিন আনোয়ার, একই দিনে অর্থাৎ ২৫ আগস্ট জন্মেছেন। কিন্তু জন্ম তারিখ ও জন্মক্ষণ যে এগোনো–পেছানো যায়, এটি প্রথম জেনেছি ডা. জাকিউর রহমানের কাছে। আমার বড় নাতি তানজিফ রায়হানের পৃথিবীতে আসার সময় যখন এগিয়ে এল, ডা. জাকিউর রহমান আমার কন্যাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন, ছেলের জন্মদিন ও জন্মের সময় কখন নির্ধারণ করতে চান?’ আমি জীবনে এতটা রসবোধসম্পন্ন ডাক্তার আগে কোথাও দেখিনি। যদিও ওনার বড় ভাই পরমাণুবিজ্ঞানী ড. রেজাউর রহমানের দীর্ঘ সান্নিধ্য এবং রসবোধ আস্বাদনের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমরা দুজন একই বিভাগের ছাত্র ছিলাম।

জাকিউর রহমানের কথা মনে করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্যরাও ইনাম ভাইয়ের ৮০তম জন্মদিন দুই দিন এগিয়ে এনে আজ ২৩ আগস্ট ২০২৫, শনিবার বিকেল ৪টায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছে জীবনে দুজন সালিম আলীর জন্মদিন উদ্‌যাপন করার। প্রথমটি ১৯৮২ সালে ভারতের বোম্বের সঞ্জয় গান্ধী জাতীয় উদ্যানে (আগের নাম বরিভলি জাতীয় উদ্যান) আমার শিক্ষক ড. সালিম আলীর ৮৬তম জন্মদিন। দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের সালিম আলীখ্যাত ইনাম আল হকের।
১৯৮২ সালের ১২ নভেম্বর আমরা সালিম আলীকে ‘বার্ড ওয়াচিং’–এর জন্য খুব ভোরে সঞ্জয় গান্ধী জাতীয় উদ্যানে নিয়ে গেলাম। স্যারের বান্ধবী দিলনাওয়াজ ভারিয়াভা ছোট একটি কেক সঙ্গে নিলেন। সালিম আলীর প্রাণশক্তি তখনো এতটাই প্রবল যে আমরা ২০টি মোমবাতি কেকটির ওপর স্থাপন করলাম। স্যারকে ডেকে এনে যখন কেক কাটার জন্য বলা হলো, অসীম রসবোধসম্পন্ন সালিম আলী গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দিলনাওয়াজ, আরও ৫টি মোমবাতি যোগ করো, নইলে কেউ বিশ্বাস করবে না।’ আশা করি, উদ্যোক্তারা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছেন ‘বাংলাদেশের সালিম আলী’, ইনাম আল হক, আজ কীভাবে অনুভূতি প্রকাশ করবেন!

ইনাম আল হক

৮০ বছর পূর্ণ করায় ইনাম আল হককে সংবর্ধনা জানানোর লক্ষ্যে একটি প্রকাশনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বইটির নাম ‘নিসর্গ-মানব ইনাম আল হক’। ৮০ বছর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। ইনাম ভাইয়ের দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, তাঁর জীবনদর্শন নিয়েও আলোচনা হবে। কিন্তু যাঁকে নিয়ে এই শ্রদ্ধা, সংবর্ধনার আয়োজন, তাঁকে জিজ্ঞেস করুন এতে তাঁর খুব একটা বেশি কিছু আসে–যায় কি না? এ জন্য যে তিনি কখনোই অসামান্য হয়ে বেঁচে থাকতে চান না। এখানেই আমি ইনাম আল হকের মধ্যে সালিম আলীকে খুঁজে পাই। তাগিদটা শুধু আমাদেরই; কারণ, তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারলে আমরাই কৃতার্থ হব এবং আমার মনে হয়েছে, ‘তাঁকে যা দেব, তা তাঁরই দান।’ সবাই আলোচনা করবেন তিনি কী দিয়েছেন, আর আমরা কী পেয়েছি? আজকে বাংলাদেশে অসংখ্য পাখিপ্রেমী, প্রকৃতিপ্রেমী, এভারেস্টপ্রেমী, ভ্রমণপ্রেমী, শিল্পপ্রেমী ও স্বদেশপ্রেমী নির্মাণ করেছেন ইনাম ভাই।
অন্তত আমি কী পেয়েছি? আমি শ্রেণিকক্ষের বাইরের একজন শিক্ষক পেয়েছি, একজন প্রয়োজনীয় বন্ধু পেয়েছি, নির্মোহ-নির্লোভ-নিরহংকার মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। একা একজন প্রতিষ্ঠান হওয়ার সব সুযোগ উপেক্ষা করে ইনাম ভাই সবাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। একটি নয়, একাধিক।

পাখি সংরক্ষণে দেশে ‘পাখি মেলা’ তাঁর কল্যাণে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। ওয়াইল্ডটিমকে সঙ্গে নিয়ে তিনি খুব শিগগির সুন্দরবনে ‘বাঘ মেলা’ শুরু করবেন—এ প্রতিশ্রুতি তিনি ওয়াইল্ডটিমের প্রতিষ্ঠাতা এনায়েতউল্লা খান ও আমাকে দিয়েছেন। তবে এগুলো কার কাছে রেখে যাবেন, মনের গভীরে এ ‘দুশ্চিন্তা’ মাঝেমধ্যে যে তিনি করেন, একান্ত আলাপচারিতায় সেটি আমার মনে হয়েছে। একমাত্র অবলম্বন মাজেদা ভাবি ধ্রুবতারার মতো তাঁর জীবনে এসে চলেও গেলেন।
পৃথিবীতে একজন মানুষই আমার প্রতি ‘ঈর্ষান্বিত’ ছিলেন, তিনি মাজেদা ভাবি—ভাবতেন, ইনাম ভাই সম্ভবত তাঁর চেয়ে আমাকেই বেশি ভালোবাসতেন। মাজেদা ভাবি, ‘ইতিহাস পুনরাবর্তিত হয়।’ ইদানীং আমার স্ত্রীও বলা শুরু করেছেন, আমি যেন কিছুদিন ইনাম ভাইয়ের বাসায় গিয়ে থেকে আসি, তাহলেই নাকি ‘সুস্থ’ হয়ে যাব। মাজেদা ভাবি, বিধাতা আপনাকে জান্নাত দান করুন। ইনাম ভাই, সৃষ্টিকর্তা জানেন আপনাকে আমাদের কতটা প্রয়োজন। তাই প্রার্থনা করি, আপনার যেন কখনো বয়স না হয়।

মো. আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়