হামলার প্রতিবাদ গানে গানে জানায় ছায়ানট। আজ মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনের সামনে ছিল এই কর্মসূচি
হামলার প্রতিবাদ গানে গানে জানায় ছায়ানট। আজ মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনের সামনে ছিল এই কর্মসূচি

গানে গানে ছায়ানটের প্রতিবাদ, জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি সুরক্ষার আহ্বান

গান কেবল প্রাণভরে শোনারই নয়, গান কখনো কখনো হয়ে ওঠে ‘প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন’। সুর তখন শুধু সুললিত নয়, বজ্র নিনাদের মতো প্রকম্পিত করে তুলতে পারে দশ দিক। আজ শীতের শেষ বিকেলে ছায়ানট তেমনি প্রতিবাদের গান, প্রতিরোধের সুরে সুরে জানিয়েছে জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির সুরক্ষায় তারা থাকবে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।

১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে দুষ্কৃতকারীরা হামলা করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানটিতে তারা ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ওই দিনই প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা হয়েছিল। পরদিন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কার্যালয়েও একই রকম হামলা হয়।

আবহমান বাংলা সংস্কৃতির ওপর এই আক্রমণের প্রতিবাদে সংহতি সমাবেশের ডাক দিয়েছিল ছায়ানট। আজ মঙ্গলবার বিকেল ঠিক চারটায় ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটি দিয়ে প্রতিবাদের এই সাংগীতিক কার্যক্রম শুরু হয়।

ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে ছায়ানট ভবনের সামনের ফুটপাত দিয়ে দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীরা। ক্রমে সারি দীর্ঘতর হতে থাকে। পৌঁছে যায় ২৭ নম্বর মোড় পর্যন্ত। ফুটপাতে পরপর তিন সারি করে দাঁড়ানোর পরও স্থানসংকুলান না হওয়া যাঁরা একটু দেরিতে এসেছিলেন, তাঁরা সড়কের কিনারায় দাঁড়িয়ে পড়েন।

ছায়ানট ভবনের প্রধান প্রবেশপথের সামনে টেবিল পেতে খোল, তবলা, হারমোনিয়াম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র স্থাপন করে যন্ত্রশিল্পীরা বাদান করছিলেন। আর গানের দলে অংশ নেন ছায়ানটের সভাপতি সারওয়ার আলী, সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসার সঙ্গে ছায়ানটের শিক্ষক, বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, দেশের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, আবৃত্তিশিল্পী, চারুশিল্পী, দৃশ্যমাধ্যম শিল্পী, স্থপতি, আলোকচিত্রী, শিক্ষক, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, পরিবেশকর্মী, সংস্কৃতিসেবীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ।

ছায়ানটের গানে গানে প্রতিবাদের কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে উপস্থিত হন অনেকে। আজ মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনের সামনে ছিল এই কর্মসূচি

বিরতিহীনভাবে একের পর এক গান গেয়ে চলেন শিল্পীরা। সংহতি প্রকাশ করতে আসা অনেকেই কণ্ঠ মেলান তাঁদের সঙ্গে। কণ্ঠ ছেড়ে গেয়েছেন তাঁরা ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝরনার মতো চঞ্চল’, ‘চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে’। এগিয়ে চলার এমন প্রত্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে গানের কথায় প্রকাশিত হয়েছে গভীর দেশপ্রেম, উদ্ভাসিত হয় বাংলার প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, এসেছে বরাভয়, আপন কর্তব্যে অটল থাকার প্রেরণা।

খুবই গোছানো, পরিকল্পিত ছিল আয়োজনটি। ছায়ানটের প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতায় যেমন থাকে, এই প্রতিবাদী আয়োজনেরও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। গানগুলো আগে থেকেই অনুশীলন করা হয়েছিল। গানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে যেন অসুবিধা না হয়, এ জন্য অনেকে ছাপা কাগজে গানের বাণী সঙ্গে রেখেছিলেন।

হামলার প্রতিবাদ গানে গানে জানায় ছায়ানট। তাতে অংশ নেন সংগীত বিদ্যায়তনটির শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা

এই আয়োজনে সংহতি জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, অধ্যাপক শফি আহমদ, অধ্যাপক এম এম আকাশ, সংগীতশিল্পী খুরশীদ আলম, খায়রুল আনাম শাকিল, বুলবুল ইসলাম, শারমিন সাথী ইসলাম, অদিতি মহসীন, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি, কৃষ্ণকলি ইসলাম, জান্নাত ই ফেরদৌসী, আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, ডালিয়া আহমদ, নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, তামান্না রহমান, ওয়ার্দা রিহাব, চারুশিল্পী নাসিম আহমদ নাদভী, মো. মনিরুজ্জামান, প্রশান্ত কর্মকারসহ অনেকে।

গানে গানে মানবতার কথা, আত্মপরিচয়ের গৌরব, সংকল্প আর সম্প্রীতির কথাও তুলে ধরেন শিল্পীরা। পরের গানগুলোর মধ্যে ছিল ‘ মানুষ ছাড়া খ্যাপা রে তুই মূল হারাবি’, ‘মানুষ হ, মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ’, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন’, ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ’, ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’।

গানে গানে প্রতিবাদের কর্মসূচিতে ছায়ানট সভাপতি সারওয়ার আলী বলেন, বাঙালি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির সুরক্ষায় প্রত্যেককে কর্ম–উদ্যোগ নিতে হবে

গানের পালায় এই পর্যায়ে এসে বিরতি পড়ে, সংক্ষিপ্ত কথা নিয়ে আসেন ছায়ানট সভাপতি সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, ছায়ানট ভবন আক্রান্ত হওয়ার প্রতিবাদে দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক অনুরাগীরা এই সমাবেশে অংশ নিয়েছেন এবং দেশের বাইরে থেকে অগণিত মানুষ সংহতি প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

ছায়ানট সভাপতি বলেন, সাম্প্রতিক কালে ছায়ানট, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও বাউলসমাজের ওপর একটি বিশেষ মহল সহিংস আক্রমণ চালিয়েছে। তারা বিভ্রান্তকর অপপ্রচার চালিয়ে আবহমান বাংলা সংস্কৃতিচর্চা থেকে নিবৃত্ত করতে উদ্যত হয়েছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ড বাঙালি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হেনেছে।

ছায়ানটের প্রতিবাদী কর্মসূচিতে সংস্কৃতিকর্মীদের পাশাপাশি বহু সাধারণ মানুষ একাত্মতা জানান। আজ মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনের সামনে

গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের কথা তুলে ধরে সারওয়ার আলী বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে চলা শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা দেশবাসীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছে। তিনি এই পরিস্থিতিতে বাঙালি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির সুরক্ষায় প্রত্যেককে নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে যথাযোগ্য কর্ম–উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।

সংক্ষিপ্ত কথার পর জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে শেষ হয় এই গানের প্রতিবাদ।

পরে ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ এই প্রতিবাদী আয়োজনে সংহিত প্রকাশ করে শিল্পীরা ছাড়াও সমাজের সর্বস্তরের বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন। সবার এই সম্মিলিত সংহতি আমাদের সাহসী ও অনুপ্রাণিত করেছে। এখন সবাইকে জোটবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে।’