সংগ্রহশালায় দেওয়া শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই বিক্রি করা নিয়ে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে একটি বক্তব্য দিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
তাতে দাবি করা হয়েছে, প্রতিবেদনে কিছু ‘আংশিক সত্য’ উপস্থাপন করা হয়েছে; কিছু অংশ এমনভাবে হাইলাইট করা হয়েছে, যাতে পাঠক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়বেন।
৮ নভেম্বর প্রকাশিত ‘জাহানারা ইমামের দেওয়া বই বিক্রি করেছে বাংলা একাডেমি, এখন দাম হাঁকা হচ্ছে লাখ টাকা’ শিরোনামের প্রতিবেদন নিয়ে ৯ নভেম্বর একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম ‘বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগারের জাহানারা ইমাম সংগ্রহের বই–সম্পর্কিত বিতর্ক বিষয়ে বাংলা একাডেমির বক্তব্য’ পাঠান।
‘অনলাইনে বিভ্রান্তিকর শিরোনাম এবং হাইলাইটস ব্যাপকভাবে টেমপ্লেট আকারে প্রচারিত হয়েছে’ জানিয়ে লিখিত এই বক্তব্যে বলা হয়, এটি বহুজনের মনোযোগের বিষয় হয়ে ওঠার কারণে বাংলা একাডেমি শুধু সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রে বক্তব্য না পাঠিয়ে সাধারণ বিবৃতি আকারে দিয়েছে।
বই বিক্রির ব্যাখ্যায় বাংলা একাডেমির বক্তব্যে বলা হয়েছে, পরিত্যক্ত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে মজুত থাকা কয়েক হাজার বই ও অন্য কাগজপত্র গত ২৫ জুন থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিধি অনুযায়ী নিলামে বিক্রি করা হয়। কারণ, মজুত রাখার ঘরটি সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।
কয়েক বছর আগে থেকে জাহানারা ইমামসহ অন্যদের দেওয়া বইগুলো যেভাবে ছিল, ঠিক সেভাবেই আছে জানিয়ে বাংলা একাডেমি বলেছে, এ বিষয়ে কোনো নতুন কমিটি গঠিত হয়নি বা সংগ্রহশালা পুনর্মূল্যায়নের কোনো ঘটনাও ঘটেনি। অন্তত এক দশক ধরে জমা হওয়া পরিত্যক্ত বইগুলোই কেবল বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে নতুন যুক্ত হয়েছে কেবল গত বছরের বইমেলায় প্রাপ্ত মানহীন ও পরিত্যক্ত ঘোষিত বইগুলো।
২০১৪ সালে ‘বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার পুনর্বিন্যাস–সংক্রান্ত কমিটি’ গঠনের তথ্য জানিয়ে বক্তব্যে বলা হয়, ওই কমিটি গ্রন্থাগার থেকে ছাঁটাইয়ের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে, সে জন্য একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। ওই উপকমিটি দীর্ঘদিন ধরে অনেকগুলো সভা করে এবং কোন বইগুলো গ্রন্থাগারে থাকবে না, তা নির্ধারণ করেছে।
বাংলা একাডেমিতে জাহানারা ইমামের পরিবারের পক্ষ থেকে মোট ৩৫৯টি বই দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে বাংলা একাডেমির বক্তব্যে বলা হয়, তখন বাছাইয়ের পরে অধিকাংশ বই সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট হয়। ওই বইগুলো বাংলা একাডেমির নির্দিষ্ট সেলফে মজুত আছে। সেখানে বইয়ের সংখ্যা ৩০৮টি।
বক্তব্যে আরও বলা হয়েছে, ‘বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা দায় কৌশলে বহুগুণ বাড়িয়ে বর্তমান প্রশাসনের ওপর বর্তানো নিশ্চয়ই সুরুচির পরিচয় নয়, সাংবাদিকতার তো নয়ই।’
তবে জাহানারা ইমামসহ অন্য সংগ্রহের যেসব বই গ্রন্থাগারের জন্য উপযোগী বিবেচিত হয়নি, সেগুলো আলাদা করে আর্কাইভ করা যেত বলে স্বীকার করা হয় বক্তব্যে।
সেই সঙ্গে বলা হয়, ‘কিন্তু এ ধরনের পরিকল্পনা তখনকার দায়িত্বশীলরা কেন করেননি, তা এখন অনুমান করা কঠিন।’
বর্তমান প্রশাসনের বইগুলো বিক্রির আগে আরেকবার পরীক্ষা করার সুযোগ থাকলেও তা যে কঠিন কাজ, তা তুলে ধরে বক্তব্যে বলা হয়, ‘বইয়ের সংখ্যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার। তদুপরি, গুরুত্বপূর্ণ কোনো বই এখানে থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনাও সংশ্লিষ্ট কারও অভিজ্ঞতায় ছিল না।’
বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদন পড়ে মনে হবে, জাহানারা ইমামের বই আলাদা করে অথবা শনাক্ত করে অথবা ইচ্ছা করে বিক্রি করা হয়েছে, এবং কাজটা করেছে বর্তমান প্রশাসন।
‘জাহানারা ইমামসহ আমাদের দেশের শ্রদ্ধেয় মানুষদের বেশ কিছু বই বাংলা একাডেমির সিলসহ নীলক্ষেতে কিংবা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হচ্ছে—এ ঘটনায় নিঃসন্দেহে বাংলা একাডেমির দায় আছে। কিন্তু বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা দায় কৌশলে বহুগুণ বাড়িয়ে বর্তমান প্রশাসনের ওপর বর্তানো নিশ্চয়ই সুরুচির পরিচয় নয়, সাংবাদিকতার তো নয়ই,’ বলা হয় বক্তব্যে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য
সংবাদ প্রকাশের প্রচলিত সব রীতি মেনেই প্রথম আলো এই সংবাদটি প্রকাশ করেছে। প্রকাশের আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বক্তব্যও নেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে কোনো তথ্যগত ভুল রয়েছে, বাংলা একাডেমির বক্তব্যে এমন কিছু নির্দিষ্ট করা হয়নি। মূলত প্রতিবেদন লেখার ধরন নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
‘জাহানারা ইমামের দেওয়া বই বিক্রি করেছে বাংলা একাডেমি, এখন দাম হাঁকা হচ্ছে লাখ টাকা’ এই শিরোনাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলা একাডেমি। কিন্তু এখানে দুটি তথ্যই সঠিক। প্রথম আলো কোনো অতিরঞ্জনও করেনি।
বাংলা একাডেমির বক্তব্যে জাহানারা ইমামের দুটি বই বিক্রির দাবি করা হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনেও এটার উল্লেখ ছিল। সেই সঙ্গে আরও অন্তত ২০টি বই বাংলা একাডেমির সিলসহ অনলাইনে বিক্রির তথ্য দেওয়া হয়েছিল।
বাংলা একাডেমির বক্তব্যেই এখন বলা হয়েছে, জাহানারা ইমামের সংগ্রহশালার ৩৫৯টি বই পেয়েছিল বাংলা একাডেমি, এখন রয়েছে ৩০৮টি। অর্থাৎ ৫১টি বই নেই।
২০১৪ সালে গঠিত উপকমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বই বাতিল হয়েছে বলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম প্রথম আলোকেও বলেছিলেন। কিন্তু সভা কার্যবিবরণীতে সুস্পষ্ট কিছু না পেয়ে প্রথম আলো কথা বলেছিল ওই উপকমিটির সদস্য শিশু একাডেমির গ্রন্থাগারিক রেজিনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান যে কোন কোন বই ছাঁটাই হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছিল বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার বিভাগের ওপর।
রেজিনা আক্তারের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বাংলা একাডেমির বক্তব্যে বই ছাঁটাইয়ের মূল দায় ওই উপকমিটিকে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সভার কিছু নথিও যুক্ত করা হয়েছে। গ্রন্থাগারের তখনকার কর্মী এবং ছাঁটাই কমিটির এক সদস্যের তথ্যের বরাতে এই দাবি করেন মোহাম্মদ আজম। ‘তাঁরা বই বাছাইয়ের কাজই না করবেন, তাহলে এতগুলো সভা কেন হলো?’ তিনি এই প্রশ্ন রাখলেও তাঁরাই তালিকা করেছিলেন, এমন কোনো প্রামাণিক দলিল তিনি দেননি।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে সৈয়দ আব্দুল হাদীর বক্তব্য উপস্থাপন নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে বাংলা একাডেমির বক্তব্যে। বলা হয়েছে, যেখানে বইগুলো চিহ্নিতই ছিল না, সেখানে ‘স্পষ্ট অন্যায়’টা কার, তা স্পষ্ট না করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন জাহানারা ইমামের বইগুলোই বিক্রি করা হয়েছে।
জাহানারা ইমামের বইয়ের ঘটনাটি তুলে ধরে কারও সংগ্রহশালার বই এভাবে বিক্রি করা যায় কি না—প্রথম আলো তা জানতে চাইলে সৈয়দ আব্দুল হাদী বলেছিলেন, ‘যদি বাংলা একাডেমি জাহানারা ইমামের বই এভাবে বিক্রি করে থাকে, তাহলে তা সম্পূর্ণ লাইব্রেরি সায়েন্সের নীতি পরিপন্থী কাজ করেছে। এটা স্পষ্ট অন্যায়।’
এখানে স্পষ্টভাবেই প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমির কথা বলা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোথাও ব্যক্তি হিসেবে কাউকে দায়ী করার কথা বলা হয়নি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল, তাঁর বক্তব্যও কোথাও কাটছাঁট করা হয়নি।