Thank you for trying Sticky AMP!!

চট্টগ্রাম ওয়াসা

বছরে ৯১২ কোটি লিটার পানি হাওয়া

পাইপলাইনে ফুটোর কারণে নষ্ট হয় এসব পানি। ফুটো মেরামতে গত পাঁচ বছরে খরচ হয়েছে ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম নগরের ৪০ শতাংশ এলাকায় ওয়াসার পানির জন্য হাহাকার রয়েছে। কোথাও সংযোগ থাকলেও পানি নেই। আর কোথাও সংযোগই নেই। অথচ পাইপের ফুটোর কারণে প্রতিবছর অন্তত ৯১২ কোটি লিটার পানি নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হওয়া পানির দাম প্রায় ২৫ কোটি টাকা। আবার এই ফুটো সারাতে বছরে গড়ে খরচ হয় এক কোটি টাকার বেশি।

এই ক্ষতি কমাতে ওয়াসার তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞ, ওয়াসার বোর্ড সদস্য ও ভোক্তা অধিকার সংগঠনের নেতারা বলছেন, এই অপচয় বন্ধ করতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নেই।

প্রতিবছর প্রায় এক হাজার কোটি লিটার পানি নষ্ট হচ্ছে। এতে গ্রাহক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ পরিমাণ পানি বাঁচানো গেলে পানির দাম বাড়াতে হয় না। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সেদিকে নজর নেই। উল্টো সিস্টেম লসের নামে অবৈধ সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ বহু পুরোনো।
মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান, ডিন, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
কয়েক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে ওয়াসার পানি–সংকট চরমে

ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, এই ফুটোর অপচয় ওয়াসা থেকে কোনো দিনও যাবে না। কারণ, নষ্ট হওয়ার নামে কিছু পানি বিক্রি হয়। ফুটো মেরামতের নামেও বাড়তি বিল করা যায়। এতে কিছু টাকা কর্তাব্যক্তিদের পকেটে চলে যায়।

চট্টগ্রাম ওয়াসা পুরো নগরকে চারটি বড় এলাকায় ভাগ করে পানি সরবরাহ করে। এসব এলাকাকে ‘মড’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্থার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ আছে ৭৮ হাজার ৫৪২টি এবং বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। কমবেশি ১০ হাজার গ্রাহক ‘লাইন চার্জ’ দিয়েও নিয়মিত পানি পান না বলে জানা গেছে।

Also Read: চট্টগ্রাম ওয়াসার সংযোগ ২০ বছর আগে, নিয়মিত বিল দিয়ে পানি পাননি এক দিনও

উৎপাদন চিত্র অনুযায়ী, বর্তমানে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা হচ্ছে। ৯২ শতাংশ পানি হালদা ও কর্ণফুলী নদী থেকে নিয়ে পরিশোধন করা হয়। বাকি ৮ শতাংশ পানি আসে গভীর নলকূপ থেকে।

এভাবেই বছরে ৯১২ কোটি লিটার পানি হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এসব পানির বিল পাচ্ছে না সংস্থাটি। ওয়াসা দাবি করে, এক হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে সংস্থার খরচ হয় ২৭ টাকা।

ওয়াসার হিসাবেই, উৎপাদিত পানির মধ্যে পাইপে ফুটোর কারণে প্রতিদিন নষ্ট হয় আড়াই কোটি লিটার। এভাবেই বছরে ৯১২ কোটি লিটার পানি হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এসব পানির বিল পাচ্ছে না সংস্থাটি। ওয়াসা দাবি করে, এক হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে সংস্থার খরচ হয় ২৭ টাকা। পানি পরিশোধনে ব্যবহৃত রাসায়নিক, বিদ্যুৎ খরচ, জনবলের বেতন-ভাতা অন্তর্ভুক্ত করে এ উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে ৯১২ কোটি লিটার পানি উৎপাদনে খরচ হচ্ছে প্রায় ২৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

ফুটোর কারণে পানির অপচয় রোধ করা গেলে নগরের বড় একটি অংশে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যেত বলে মনে করেন ওয়াসার প্রকৌশলীরা। বিশেষ করে নগরের বাকলিয়া, হালিশহর, উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা, পাহাড়তলী, বাঘগোনা, আকবর শাহসহ বিভিন্ন এলাকায় বছরজুড়ে পানির সংকট থাকে। এসব এলাকার গ্রাহকেরা কখনো কখনো সপ্তাহে এক দিনও পানি পান না।

পাহাড়তলীর ব্যাংক কলোনি এলাকার বাসিন্দা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা কে এম মোস্তফিজুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ২১ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ দিনে মাত্র দুবার পানি পেয়েছেন। প্রতি মাসেই তাঁর এই পানির কষ্ট।

অথচ পাইপে ফুটোর কারণে কোটি কোটি লিটার পানি নালায় চলে যাচ্ছে। সংযোগ পাইপে ফুটো যাতে না হয়, তার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নানা কারণে ফুটো হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে কমে এসেছে। এ ছাড়া নতুন পাইপলাইন বসানো হয়েছে। নতুন লাইনে ফুটো কম হচ্ছে।

নথি অনুযায়ী, বর্তমানে ওয়াসার উৎপাদিত ৩০ ভাগ পানি গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় না। এই পানির কোনো বিল আদায় হয় না। কাগজে-কলমে এটিকে সিস্টেম লস বা কারিগরি অপচয় বলা হয়। ৩০ ভাগের মধ্যে ৫ ভাগ ফুটোর কারণে নষ্ট হয়। বাকি ২৫ ভাগ চুরি, অবৈধ সংযোগ, মিটারে কারসাজির মাধ্যমে নষ্ট হয় বলে দাবি করেছেন ওয়াসার প্রকৌশলীরা। দেশে ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসায় ‘সিস্টেম লস’ চট্টগ্রামের চেয়ে কম। ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম লস ২০ শতাংশ, রাজশাহী ওয়াসায় ২৯ শতাংশ ও খুলনা ওয়াসায় ২৪ শতাংশ।

সিস্টেম লস না কমিয়ে গত পাঁচ বছরে চারবার পানির দাম বাড়িয়েছে ওয়াসা। সর্বশেষ বাড়ানো হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। বর্তমানে আবাসিকে এক হাজার লিটার পানির দাম ১৮ টাকা, বাণিজ্যিকে ৩৭ টাকা।

২১ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ দিনে মাত্র দুবার পানি পেয়েছেন। প্রতি মাসেই তাঁর এই পানির কষ্ট।
পাহাড়তলীর ব্যাংক কলোনি এলাকার বাসিন্দা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা কে এম মোস্তফিজুল কবির

নতুন পাইপ, তবু ফুটো

১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরু করা ওয়াসা বর্তমানে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে নগরজুড়ে পানি সরবরাহ করে। এর মধ্যে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৮৯১ কিলোমিটার পাইপলাইন নতুন করে বসানো হয়েছে। বাকি লাইন এখনো পুরোনো। তবে নতুন ও পুরোনো দুই পাইপলাইনেই ফুটো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সংস্থার নথি অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ওয়াসা নগরের ৬৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পানি সরবরাহ করত। এর পর থেকে নতুন নতুন প্রকল্পে বেড়েছে পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য। ২০০৯ সালে শুরু হয় কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ৬৮ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো হয়। এরপর ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ। বসানো হয় ১৩৬ কিলোমিটার পাইপলাইন। ২০১৩ সালে শুরু হয় কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-২)। কাজ শেষ হয় গত বছর। এই প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ৬৮৭ দশমিক ৫২ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো হয়েছে।

সংস্থাটি লিখিতভাবে জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে পাইপে ১০ হাজার ৪৬৮টি ফুটো হয়েছে।

নতুন পাইপে ফুটো হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মড-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইফতেখার উল্লাহ। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করে বলেন, সড়কে ভারী যানবাহন চলাচল করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়। এতে পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফুটো হচ্ছে।

গত পাঁচ বছরে পাইপলাইনে কত হাজার ফুটো হয়েছে এবং মেরামত বাবদ কত টাকা খরচ হয়েছে, তা জানতে গত ১৮ জানুয়ারি ওয়াসায় তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করা হয়। পরে সংস্থাটি লিখিতভাবে জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে পাইপে ১০ হাজার ৪৬৮টি ফুটো হয়েছে।

ফুটোর কারণে নষ্ট পানির জন্য কোটি টাকা গচ্চার পাশাপাশি মেরামত করতেও গুনতে হচ্ছে কোটি টাকা। ফুটো মেরামতে গত পাঁচ বছরে খরচ হয়েছে ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে মড-৩-এ পাঁচ বছরে মাত্র দেড় হাজার ফুটো মেরামতে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।

ওয়াসার দুজন বোর্ড সদস্য অভিযোগ করেন, মাত্র দেড় হাজার ফুটো মেরামতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। আদতে এসব ফুটো মেরামতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।

মাত্র দেড় হাজার ফুটো মেরামতে কোটি টাকা খরচ হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ অবাক হন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি শুনে আমিও অবাক হলাম। এত টাকা খরচ কীভাবে হলো, তার খোঁজখবর নেওয়া হবে।’

প্রতিবছর প্রায় এক হাজার কোটি লিটার পানি নষ্ট হচ্ছে। এতে গ্রাহক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ পরিমাণ পানি বাঁচানো গেলে পানির দাম বাড়াতে হয় না।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান

সদিচ্ছা নেই, পরিকল্পনায় ঘাটতি

ফুটোর মাধ্যমে পানির অপচয় রোধে ওয়াসার পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি বলেন, প্রতিবছর প্রায় এক হাজার কোটি লিটার পানি নষ্ট হচ্ছে। এতে গ্রাহক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ পরিমাণ পানি বাঁচানো গেলে পানির দাম বাড়াতে হয় না। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সেদিকে নজর নেই। উল্টো সিস্টেম লসের নামে অবৈধ সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ বহু পুরোনো। ফলে সার্বিকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করা না গেলে অপচয় কমবে না।