
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের মধ্যে নিহত কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম হত্যাকাণ্ডের ৪৭ বছর পর করা মামলার তদন্ত শেষ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাতে তৎকালীন সেনাপ্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, মেজর (অব.) মো. আবদুল জলিল ও মেজর (অব.) আসাদ উজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি জানিয়ে তাঁদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে এ হত্যাকাণ্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরের (অব.) দায় পেলেও মৃত হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগপত্র দেননি তদন্ত কর্মকর্তা।
গত ৩০ নভেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ঢাকা মেট্রোর পরিদর্শক সিকদার মহিতুল আলম। তাঁর এই প্রতিবেদন আদালতে গৃহীত হলে দৃশ্যত এ মামলার যবনিকাপাত হবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর অস্থিরতার মধ্যে ৩ নভেম্বর সামরিক বাহিনীতে এক অভ্যুত্থান ঘটে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে। তখন বন্দী করা হয়েছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে। চার দিন পর ৭ নভেম্বর আবু তাহেরের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থানে মুক্ত করা হয় জিয়াউর রহমানকে। সেদিনই দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অফিসে (বর্তমানে জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণ) নিহত হন খালেদ মোশাররফ, নাজমুল হুদা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার।
কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা হত্যাকাণ্ডের ৪৭ বছর পর ২০২৩ সালে মামলা করেন তাঁর মেয়ে নাহিদ ইজাহার খান। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় মেজর জলিলকে। হুকুমের আসামি করা হয় জিয়াউর রহমান ও কর্নেল তাহেরকে।
নাজমুল হুদা মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরে একটি সাবসেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেছিল, সে মামলার আসামিদের একজন ছিলেন তিনি।
৪৭ বছর পর মামলা
নাজমুল হুদা হত্যাকাণ্ডের ৪৭ বছর পর ২০২৩ সালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন তাঁর মেয়ে সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান। মামলায় মেজর (অব.) জলিলকে প্রধান আসামি করা হয়। হুকুমের আসামি করা হয় তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ও জাসদ নেতা আবু তাহেরকে।
মামলায় নাহিদ ইজাহার অভিযোগ করেন, তাঁর বাবা (নাজমুল হুদা) নিহত হওয়ার সময় তিনি ও তাঁর ভাই ছোট ছিলেন। তাঁরা বড় হয়ে বাবার কোর্সমেট, সহকর্মী ও বিভিন্ন সূত্র থেকে অনুসন্ধানে জানতে পারেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকালে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অফিসে নাজমুল হুদার সঙ্গে অপর দুই সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এবং এ টি এম হায়দার অবস্থান করছিলেন। নাজমুল হুদা সকালে নাশতা করার সময় দশম ইস্ট বেঙ্গলের সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল নওয়াজেশের কাছে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি থেকে একটি ফোন আসে। এরপর দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তারা নাজমুল হুদাসহ তিন কর্মকর্তাকে বাইরে নিয়ে যান।
গত ৩০ নভেম্বর মেজর নাজমুল হুদা হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। মামলার সঙ্গে তিনজনের সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাঁদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।সিকদার মহিতুল আলম, তদন্ত কর্মকর্তা
এরপর তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ও জাসদ নেতা আবু তাহেরের নির্দেশে দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তা, জেসিও ও সৈনিকেরা সংঘবদ্ধভাবে ঠান্ডা মাথায় নাজমুল হুদাসহ তিনজনকে হত্যা করেন বলে এজাহারে দাবি করা হয়।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে আসামি করে এ মামলা করার সময় নাহিদ ইজাহার সংসদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদে সংরক্ষিত আসনের সদস্য ছিলেন। বিএনপি তখন মামলার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিল, এর পেছনে সরকারের কারসাজি থাকতে পারে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষায় পরিবার
মামলার বিষয়ে সে সময় নাহিদ ইজাহার খান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘বাবার হত্যাকাণ্ডের সময় আমাদের দুই ভাই-বোনের বয়স যথাক্রমে পাঁচ ও আট বছর। তখন পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। বাবার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তথ্যপ্রমাণ যতটুকু হাতে পেয়েছি, সে অনুযায়ী এখনই মামলা করার সঠিক সময় বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।’
জিয়াউর রহমান, এম এ জলিল ও মেজর (অব.) আসাদ উজ্জামানের এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কর্নেল আবু তাহেরের দায় পেলেও মৃত হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগপত্র দেননি তদন্ত কর্মকর্তা।
দুই বছর পর মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলে নাহিদ ইজাহারের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
হত্যার সময়ের ঘটনা তুলে ধরে ২০২৩ সালের ১০ মে নাজমুল হুদার ছেলে এহতেশাম হুদা ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেন। তিনি বলেছিলেন, সেদিন তাঁর খালু তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে ফোন করে মৃতদেহ হস্তান্তরের অনুরোধ করেন। তাঁর মা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কথা বলে একটা জাতীয় পতাকা ও সেনানিবাস কবরস্থানে মৃতদেহ দাফনের অনুরোধ করেন। জিয়া অনুরোধ রাখেননি। পরে তাঁর বাবাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
২ বছর পর তদন্ত প্রতিবেদন
মামলার তদন্ত শেষে ৩০ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন সিআইডির ঢাকা মেট্রোর পরিদর্শক সিকদার মহিতুল আলম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলা হয়, খালেদ মোশাররফ তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। বাদী নাহিদ ইজাহারের বাবা নাজমুল হুদা তখন রংপুরে ৭২ ব্রিগেডে কমান্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। খালেদ মোশাররফ ৪ নভেম্বর তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এর মধ্যে অবসরে থাকা কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সাধারণ সৈনিক ও জাসদের রাজনীতিবিদদের সহযোগিতায় বামপন্থী সেনাসদস্য দ্বারা পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। জিয়াউর রহমান মুক্ত হলেও ঘাত-প্রতিঘাত, সেনা ও রাজনৈতিক পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে ৭ নভেম্বর ভোর চারটা থেকে সকাল আটটার মধ্যে জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেল মাঠে কর্নেল নাজমুল হুদাকে গুলি করে ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়।
এই তিন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার জন্য মুক্তিযুদ্ধেরই আরেক সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরকে দায়ী করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁর নির্দেশে সেনাবাহিনীর অজ্ঞাতনামা সদস্যরা ও বাম রাজনীতির মদদে নাজমুল হুদাকে হত্যা করা হয়েছে, যা পেনাল কোডের ৩০২/১০৯/৩৪ ধারার অপরাধ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। পরে সেনা কর্মকর্তা হত্যার দায়ে সামরিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। এ কারণে অপরাধ সত্য প্রমাণিত হলেও তিনি মারা যাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়নি।
জিয়া–জলিল–আসাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ মেলেনি
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, মেজর (অব.) আবদুল জলিল ও মেজর (অব.) আসাদ উজ্জামানের এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মূলত হত্যাকাণ্ডটি ছিল পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের কারণে।
বাদীকে বারবার নোটিশ দিলেও তিনি কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
সিকদার মহিতুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ৩০ নভেম্বর মেজর নাজমুল হুদা হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। মামলার সঙ্গে তিনজনের সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাঁদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।