
ঠিক এক বছর আগে, গত বছরের জুলাইয়ে লাশের পর লাশ আসছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখন প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা পালা করে সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, অনেক ক্ষেত্রে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। কখনো আবার হয়নি। ঠিক কতটি মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে, আমরা জানি না।
অস্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ কী কারণে মারা গেলেন, তা জানার জন্য ময়নাতদন্ত জরুরি। ময়নাতদন্ত ছাড়া হত্যা ঘটনার তদন্ত ও বিচার বাধাগ্রস্ত হয়, সেটা সবার জানা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল ন্যায়বিচার। ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম সরকার পতনের এক দফা দাবির ঘোষণার সময় ‘সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা’র কথা বলেছিলেন।
আমরা দেখলাম ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ঘিরে (ফেসবুকে নেতাদের অনেকে একে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জও’ বলেছেন) কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের হামলা, পরে সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় নিহত চারজনের ময়নাতদন্ত হয়নি।
সমাজে ন্যায়বিচার কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়। কাউকে তার বাইরেও রাখা যায় না। ন্যায়বিচার সবার জন্য, এমনকি অপরাধীও ন্যায়বিচারের দাবিদার।
আমরা দেখলাম ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ঘিরে (ফেসবুকে নেতাদের অনেকে একে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জও’ বলেছেন) কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের হামলা, পরে সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় নিহত চারজনের ময়নাতদন্ত হয়নি। পুলিশ লাশের সুরতহালও করেনি। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। পরে শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া একজনের ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত হয়েছে।
কোনো মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। সুরতহালে একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাঁর দেহের পরিস্থিতির বিবরণ থাকে। কী অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়া গেল, পরনে কী পোশাক ছিল, আঘাতের চিহ্ন ছিল কি না ইত্যাদি বিস্তারিত বর্ণনা থাকে।
ময়নাতদন্ত (পোস্ট মর্টেম) প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকে মৃত্যুর কারণ। ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করেন, ঠিক কীভাবে মৃত্যু হয়েছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরে প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ লিখে দেওয়া হয়। সাধারণত সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ময়নাতদন্ত করে থাকেন।
ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) ও পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির যদি অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই মৃত ব্যক্তির সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করতে হবে। সাক্ষ্য আইনে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ সাইফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া হত্যা মামলার তদন্ত হলে শেষ বিচারে মামলার ফলাফল আসামিপক্ষে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করেন, ঠিক কীভাবে মৃত্যু হয়েছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরে প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ লিখে দেওয়া হয়। সাধারণত সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ময়নাতদন্ত করে থাকেন।
ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার কোনো ব্যক্তির লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে নিহত চারজনের ক্ষেত্রে (ইমন তালুকদার, সোহেল মোল্লা, রমজান কাজী ও দীপ্ত সাহা) সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত হয়নি।
সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তিনি দুটি প্রশ্ন করেন। প্রথম প্রশ্নে তিনি গোপালগঞ্জের ঘটনায় কেন স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়নি, তা জানতে চান। দ্বিতীয় প্রশ্নে তিনি ময়নাতদন্ত না হওয়ার বিষয়টি তোলেন।
ডেভিড বার্গম্যানের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ফেসবুকে তাঁর পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ঘটনা তদন্তে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। অন্যদিকে পরিবার জোর করে লাশ নিয়ে যাওয়ায় ময়নাতদন্ত সম্ভব হয়নি। তবে গোপালগঞ্জের পুলিশ আজ রোববার আদালতের কাছে ময়নাতদন্তের জন্য তিনজনের মরদেহ কবর থেকে তোলার অনুমতি চাইতে পারে।
বার্গম্যান স্বাধীন তদন্ত কমিটির কথা বলেছিলেন। সরকার করেছে সরকারি তদন্ত কমিটি। অন্যদিকে গণমাধ্যমে এসেছে, নিহতদের স্বজনেরা ময়নাতদন্ত করাতে চেয়েছিলেন। এ বিষয় উল্লেখ করে বার্গম্যান আরেকটি পোস্ট দিয়েছেন।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, প্রয়োজনে নিহত ব্যক্তিদের লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হবে।
১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে নিহত চারজনের ক্ষেত্রে (ইমন তালুকদার, সোহেল মোল্লা, রমজান কাজী ও দীপ্ত সাহা) সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত হয়নি।
গোপালগঞ্জে মারা যাওয়াদের মধ্যে একজন হিন্দুধর্মাবলম্বী, নাম দীপ্ত সাহা। পরিবার তাঁর মরদেহ সৎকার করে দাহ করেছে। তাঁর ক্ষেত্রে আর ময়নাতদন্তের সুযোগ নেই (প্রেস সচিবও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন)। ফলে দীপ্ত সাহার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার না হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তিনি হামলাকারী হয়ে থাকলেও ন্যায়বিচার তাঁর পরিবারের প্রাপ্য।
গোপালগঞ্জে হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় চারটি মামলায় তিন হাজারের বেশি লোককে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু নিহত পাঁচজনের পরিবারের কেউ মামলা করতে চান না। পুলিশ বাদী হয়েও মামলা করেনি।
নিহত রমজান কাজীর মামা কলিম মুন্সী গতকাল বলছিলেন, ‘কী হবে মামলা করে?’ মানুষের এমন বক্তব্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শোনা গেছে। সভ্য রাষ্ট্রে এমন হওয়া উচিত, যেখানে সবাই বিচার চাইবে, সেটা রায় বিপক্ষে গেলেও।
এখন যে তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা তো একান্ত সরকারের। শুধু সরকারি না, যেসব মন্ত্রণালয়ের ওপর তদন্ত হবে, তাদের লোকজন নিয়েই তো তার মধ্যে বসানো হয়েছে। সমস্যা তো সেখানে।ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন
গোপালগঞ্জের ঘটনা তদন্তে সরকার ১৭ জুলাই তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনি। কমিটির অন্য দুই সদস্য হিসেবে থাকছেন দুজন অতিরিক্ত সচিব। তাঁদের একজন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের, আরেকজন আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের।
কমিটিটি সরকারি। সরকারি কমিটি স্বাধীন তদন্ত করবে, সেটা আশা করা কঠিন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘এখন যে তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা তো একান্ত সরকারের। শুধু সরকারি না, যেসব মন্ত্রণালয়ের ওপর তদন্ত হবে, তাদের লোকজন নিয়েই তো তার মধ্যে বসানো হয়েছে। সমস্যা তো সেখানে।’
নিহত রমজান কাজীর মামা কলিম মুন্সী গতকাল বলছিলেন, ‘কী হবে মামলা করে?’ মানুষের এমন বক্তব্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শোনা গেছে। সভ্য রাষ্ট্রে এমন হওয়া উচিত, যেখানে সবাই বিচার চাইবে, সেটা রায় বিপক্ষে গেলেও।
১৬ জুলাই আমরা এনসিপির পদযাত্রায় হামলার ঘটনা দেখলাম, সংঘর্ষ দেখলাম, গুলি ছুড়তে দেখলাম, ৫ জনের মৃত্যু দেখলাম। এই হামলা কতটা পরিকল্পিত ছিল, কতটা প্রস্তুতি নিয়ে হামলা করা হয়েছে, উসকানি ছিল কি না, বলপ্রয়োগ যথাযথ কি না, সংঘাত এড়ানো যেত কি না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো দায় আছে কি না, এসব নিয়ে নানা বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে তা বের করে আনা। এ জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিটি দরকার। স্বাধীন তদন্ত কমিটি করতে বাধা কোথায়, সেই প্রশ্নের জবাব এখনো সরকারের কারও পক্ষ থেকে আসেনি।
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গতকাল ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তার একাংশে তিনি লিখেছেন, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও বিচারে সহযোগিতা করুন। কিন্তু নাগরিক হিসেবে সবাই মানবাধিকারের পক্ষে থাকুন। তিনি আরও লিখেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশে আমরা মানবিক মর্যাদা, বৈষম্যহীনতা আর সুবিচারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা পূরণ করা আমাদের কর্তব্য।’ আমাদের প্রত্যাশা, মাহফুজ আলমের কথাগুলো যেন ‘কথার কথা’ না হয়ে থাকে।