
ক্যানসারের চিকিৎসা দেশে বা বিদেশে যেখানেই নেওয়া হোক—দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে এবং চিকিৎসার মাঝে গ্যাপ (বিরতি) দেওয়া যাবে না। বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেক সময় চিকিৎসায় গ্যাপ তৈরি হয়, যা রোগীর জন্য ক্ষতিকর। প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত ও দ্রুত চিকিৎসাই ফুসফুস ক্যানসার নিরাময়ের মূল চাবিকাঠি।
‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় টিএমএসএস ক্যানসার সেন্টারের মেডিকেল অ্যান্ড রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ডা. মো. তৌছিফুর রহমান এসব কথা বলেন। ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে এসকেএফ অনকোলজি। উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন।
এখনো ফুসফুস ক্যানসার নিয়ে রয়েছে নানা ভ্রান্ত ধারণা ও সচেতনতার অভাব। তাই এ পর্বে ফুসফুস ক্যানসার নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন ডা. মো. তৌছিফুর রহমান। পর্বটি মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে উপস্থাপক জানতে চান, ফুসফুস ক্যানসার আসলে কী এবং বাংলাদেশের এর সংক্রমণের হার কেমন?
উত্তরে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, ফুসফুসে যে ক্যানসার হয়ে থাকে মূলত সেটিই ফুসফুস ক্যানসার। আমাদের দুটো ফুসফুস—ডান ফুসফুস তুলনামূলকভাবে বড় এবং বাম ফুসফুস একটু ছোট। ফুসফুস ক্যানসারকে দুই ভাগে করা হয়—স্মল সেল ফুসফুস ক্যানসার এবং নন–স্মল সেল ফুসফুস ক্যানসার। নন–স্মল সেল ফুসফুস ক্যানসার সাধারণত চার ধরনের হয়—স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা, অ্যাডেনোকারসিনোমা, লার্জ সেল কারসিনোমা এবং আনডিফারেনশিয়েটেড কারসিনোমা।
ডা. মো. তৌছিফুর রহমান আরও বলেন, বাংলাদেশে এ রোগের প্রকৃত পরিসংখ্যান এখনো স্পষ্ট নয়, তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এটি দ্বিতীয় সর্বাধিক শনাক্তকৃত একটি ক্যানসার। প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ এতে আক্রান্ত হন। মৃত্যুহারের দিক থেকেও এটি শীর্ষে রয়েছে—বার্ষিক মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। বাংলাদেশেও ব্রেস্ট ক্যানসারের মতো ফুসফুস ক্যানসার শীর্ষ দুই অবস্থানের একটিতে থাকে।
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানতে চান, ফুসফুস ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কাদের সবচেয়ে বেশি?
উত্তরে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, ফুসফুস ক্যানসারের ক্ষেত্রে সাধারণত জেনেটিক কারণগুলো খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি জীবনযাত্রা ও পরিবেশগত অভ্যাসের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। ফুসফুস ক্যানসারে প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীরই ধূমপানের ইতিহাস থাকে। তাই ধূমপানকে এখন এর ঝুঁকি নয় বরং এর প্রধান কারণ বলা হয়।
ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ—উভয় ধরনের ধূমপানই ক্ষতিকর। এ ছাড়া তামাকজাত পণ্য, বায়ুদূষণ ও ভারী ধাতুর সংস্পর্শ, ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পে কাজ, পূর্বের ফুসফুসের কোনো রোগ, ব্যায়াম না করা ও স্থূলতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, বিভিন্ন সংক্রমণ এবং রেডিয়েশনের এক্সপোজার ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
ফুসফুস ক্যানসারের লক্ষণগুলো সম্পর্কে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, ফুসফুস ক্যানসার হলে কাশির সঙ্গে রক্ত বের হয়, হুট করেই ওজন কমে যায়, গলার স্বর ভেঙে যায়, শ্বাসকষ্ট এবং বুকের ব্যথা অনুভূত হয়।
তিনি আরও বলেন, ক্যানসার শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে (মেটাস্ট্যাটিক অবস্থায়) আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন রুচিহীনতা, লিভারে ছড়ালে বমিভাব বা বমি, হাড়ে ছড়ালে দীর্ঘস্থায়ী ওষুধে ব্যথা না কমা, কোমর ব্যথা বা সহজে হাড় ভেঙে যাওয়া আর মস্তিষ্কে ছড়ালে মাথাব্যথা, বমিভাব, খিঁচুনি, পক্ষাঘাত ও দৃষ্টিসংক্রান্ত সমস্যা। তবে এগুলো সাধারণত শেষের দিকে প্রকাশ পায়।
ফুসফুস ক্যানসার শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে জেনেটিক টেস্টিং কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? জানতে চাইলে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, জেনেটিক টেস্টিং বা মলিকিউলার টেস্টের গুরুত্ব অনেক। বর্তমানে ক্যানসারের চিকিৎসা অর্গান–বেজড না হয়ে পার্সোনালাইজড মেডিসিনের দিকে যাচ্ছে, অর্থাৎ একেক রোগীর ক্ষেত্রে একেক চিকিৎসা।
তিনি বলেন, ভিন্ন ভিন্ন ক্যানসারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মিউটেশন দায়ী এবং এই মিউটেশনের ভিত্তিতে অ্যাকশনেবল টার্গেটেড থেরাপি বা ইমিউনোথেরাপি বা কেমোথেরাপি নির্ধারণ করা হয়। এই টেস্টের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ওষুধ এড়ানো যায়। মিউটেশন পজিটিভ থাকলে শুধু ওরাল ট্যাবলেট দিয়েই ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এবং এর মাধ্যমে নিরাময়ের হারও বেশ ভালো।
ফুসফুস ক্যানসারের স্টেজের ধরন এবং স্টেজিং ট্রিটমেন্টের প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, ফুসফুস ক্যানসার সাধারণত চারটি স্টেজে বিভক্ত হলেও সাধারণ মানুষের বোঝার সুবিধায় এটিকে তিন ভাগে ব্যাখ্যা করা যায়— লোকালাইজড অর্থাৎ ক্যানসার যখন শুধু ফুসফুসের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে। লোকালি অ্যাডভানসড অর্থাৎ ক্যানসার যখন আশেপাশের লসিকা গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়ে। ডিস্ট্যান্ট মেটাস্ট্যাটিক অর্থাৎ ক্যানসার যখন রক্তের মাধ্যমে শরীরের দূরবর্তী অঙ্গে ছড়িয়ে যায়।
ডা. মো. তৌছিফুর রহমান জানান, স্টেজিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটির ওপরই সারভাইভাল রেট নির্ভর করে। নন–স্মল সেল ফুসফুস ক্যানসারের ক্ষেত্রে লোকালাইজড অবস্থায় ৫ বছরের সারভাইভাল রেট প্রায় ৬৭ শতাংশ, লোকালি অ্যাডভানসড অবস্থায় ৪০ শতাংশ, আর ডিস্ট্যান্ট মেটাস্ট্যাটিক পর্যায়ে তা নেমে আসে মাত্র ১২ শতাংশে। আর্লি ডিটেকশন (প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত) এবং দ্রুত চিকিৎসাই ফুসফুস ক্যানসার নিরাময়ের মূল চাবিকাঠি।
বাংলাদেশে আর্লি ডিটেকশন বা স্ক্রিনিংয়ের সুব্যবস্থা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, হ্যাঁ, বাংলাদেশে আর্লি ডিটেকশন বা স্ক্রিনিংয়ের সুব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে জেলা লেভেলেও অন্ততপক্ষে এফএনএসি টেস্ট (হিস্টোপ্যাথোলজিক্যাল টেস্ট) করা সম্ভব।
চিকিৎসার পরে একজন ক্যানসার রোগীর করণীয় কী? আলোচনার শেষ পর্যায়ে উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, চিকিৎসার পরে রোগীকে নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে। ফুসফুস ইমিউনো কম্প্রোমাইজড থাকে, তাই তাকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন এবং নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন দিতে হবে, যাতে নিউমোনিয়ার হওয়ার আশঙ্কা না থাকে। ফুসফুস ক্যানসার রোগীর ‘মোড অব ডেথ’ হলো নিউমোনিয়া। অবশ্যই ঠান্ডা কাশি এড়িয়ে চলতে হবে। এরপরে রিহ্যাবিলিটেশন হবে। যেন আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন, এর জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে ফিট করার ব্যবস্থা নিতে হবে।