
দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া রাইসুল আহসান। ছয় বছর বয়সী রাইসুলের হাতে একটি ছাতা, কাঁধে স্কুলব্যাগ। টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাকসেল থেকে তেল, ডাল ও চিনি কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছে। আজ সোমবার বেলা ১১টায় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কথা হয় রাইসুলের সঙ্গে।
রাইসুল জানায়, পরিবারে তারা চার ভাইবোন। সে দ্বিতীয়। তার বড় এক বোন আছে, আর ছোট দুই ভাই। তার বাবা আবদুল হামিদ একটি খাবারের দোকানে কাজ করেন। কঠোর বিধিনিষেধে তার বাবার রোজগার ভালো হচ্ছে না। কিছুদিন আগে মায়ের অপারেশনে (সিজারে) আরও কিছু টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। তাই মায়ের সঙ্গে সেও এসেছে টিসিবির ট্রাকসেল থেকে পণ্য কিনতে। বড় বোন বাসায় থেকে তাঁর অন্য দুই ছোট ভাইয়ের দেখাশোনা করছে।
রাইসুল যখন কথাগুলো বলছিল, তখনই নারীদের লাইনে বিশৃঙ্খলা দেখা গেল। লাইনের পেছনের দিকে থাকা নারীরা সামনের দিকে থাকা নারীদের আরও সামনের দিকে ঠেলছেন, সামনের দিকে থাকা নারীরাও বাকিদের পেছনের দিকে ঠেলছেন। এমন ঠেলাঠেলি ও চাপাচাপির মধ্যে কয়েক নারী লাইন থেকে ছিটকে গেলেন।
এমন পরিস্থিতি দেখে নারীদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাদের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যেতেই এক নারী জানাল, তাঁর ১৩ দিন আগে সিজার হয়েছে। কোমরে বন্ধনী (বেল্ট) পরে এসেছেন। কিন্তু চাপাচাপিতে তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। পেটের কাটা অংশে ব্যথা অনুভব করছেন। নিজের নাম শাহীনা বেগম বলে জানালেন ওই নারী।
এর মধ্যেই পেছন থেকে রাইসুলের ডাক, ‘আঙ্কেল, মার জন্য ছাতাটি একটু দেবেন?’ কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তোমার মা কে?’। তখন তাঁর উত্তর, ‘যে আপনাকে বলসে না, তার সিজার হয়েছে, পেটে ব্যথা পাচ্ছে। সেই আমার মা।’ পরবর্তী সময়ে রাইসুলের লাইনে থাকা অন্য লোকেরা রাইসুলকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘বাবু, তুমি গিয়ে মার জন্য ছাতা দিয়ে আস। তোমার লাইনে জায়গা থাকবে।’ তাতে নিজেই গিয়ে মাকে ছাতাটি দিয়ে আসে সে।
রাইসুলের মা শাহীনা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী একটি খাবার হোটেলে খাবার পরিবেশনের কাজ করেন। কঠোর বিধিনিষেধে হোটেলে বসে খাবার ব্যবস্থা নেই। তাই রোজগারও নেই। কিছু জমানো টাকাও নিজের সিজারের পেছনে খরচ হয়েছে। তাই শরীরের এ অবস্থা নিয়েও টিসিবি থেকে তেল, ডাল ও চিনি কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন।
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে দেখা যায় শতাধিক নারী-পুরুষ টিসিবির ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করছেন। পণ্য নিয়ে ট্রাক পৌঁছায় পৌনে ১১টার দিকে। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে না দাঁড়িয়ে ট্রাকটি চলে যায় বছিলা তিন রাস্তার মোড়ের দিকে ঢাকা উত্তর সিটির গণশৌচগার অংশে। দাঁড়ায় উল্টো দিকের সড়কে। ট্রাকের পেছন পেছন প্রায় ২৫০ মিটার ছুটে গিয়ে লাইনে দাঁড়ান অপেক্ষমাণ লোকজন। ভিড় আর চাপাচাপিতে লাইন না হয়ে মানুষের জমাটবদ্ধ অবস্থা দেখা গেছে। বাধ্য হয়েই প্রথম দাঁড়ানোর স্থান থেকে কিছুটা এগিয়ে নতুন জায়গায় দাঁড় করানো হয় ট্রাক। একপর্যায়ে কিছুটা শৃঙ্খলা আসে। নারী ও পুরুষের পৃথক দুটি লাইন তৈরি হয় ট্রাকের পেছনে।
পরিস্থিতি সামলে নিয়ে টিসিবির পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধিরা বিক্রি শুরু করেন সাড়ে ১১টার দিকে। তখন নারী ও পুরুষের পৃথক দুটি লাইনে অন্তত ৩৫০ জন দাঁড়ানো ছিলেন। অথচ প্রতিটি ট্রাকের জন্য টিসিবির বরাদ্দ থাকে ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল ২০০টি, ডাল ৪০০ কেজি ও চিনি ৭০০ কেজি। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত পণ্য মাত্র ২০০ জনকে দেওয়া সম্ভব। আর চিনি প্রতিজনকে দুই কেজি হিসেবে ৩৫০ জনের কাছে বিক্রি করা যাবে।
টিসিবির পরিবেশক মাইশা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের বিক্রয় প্রতিনিধি আজহার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগে কখনো এত মানুষ একসঙ্গে লাইনে দাঁড়াতে দেখি নাই। যে পরিমাণ মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছেন আর ট্রাকে যে পরিমাণ পণ্য আছে, তা দিয়ে অর্ধেক মানুষকেও দেওয়া যাবে না।’ পণ্য বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ালে ভালো হয় বলেও তিনি জানান।