
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় দখল হয়েছিল লাউতলা খালের একাংশ।
মোহাম্মদপুরের বছিলায় লাউতলা খালের জায়গায় তিনতলা বাণিজ্যিক ভবনটি নির্মাণে সময় লেগেছে প্রায় দুই বছর। এ সময়ের মধ্যে সরকারের কোনো সংস্থাই নির্মাণকাজে বাধা দেয়নি। উল্টো স্থানীয় সাংসদ, কাউন্সিলরসহ আওয়ামী লীগের নেতারা অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এ বাণিজ্যিক ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন। গত সপ্তাহে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ভবনটির একাংশ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর এখন আর কেউ দায় নিতে চাইছেন না।
লাউতলা খালের একাংশ ভরাট করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্যোগে ২০১৩ সালে ‘একতা’ নামে একটি কাঁচাবাজারও গড়ে উঠেছিল। সেটিও গত সপ্তাহে উচ্ছেদ করেছে সিটি করপোরেশন। কাঁচাবাজারটির পাশেই তিনতলা বাণিজ্যিক ভবন মমতাজ শপিং কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছিল।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অঞ্চল-৫–এর সহকারী অথরাইজ কর্মকর্তা নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ওই এলাকাটি বন্যার পানিপ্রবাহের এলাকা বা ফ্লাড ফ্লো জোন। তাই সেখানে ভবন নির্মাণের কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
মোহাম্মদপুর এলাকার রামচন্দ্রপুর খালের অংশ লাউতলা খাল। এর দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই কিলোমিটার। দখল ও ভরাটে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল খালের প্রায় ৫০০ মিটার। মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকার বৃষ্টির পানি লাউতলা খাল থেকে রামচন্দ্রপুর খাল হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে নিষ্কাশিত হয়। এ খালের একাংশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বছিলা এলাকায় ভারী বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হয়। সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক অভিযানে লাউতলা খালের দখল হয়ে যাওয়া প্রায় ৩০০ মিটার অংশ উদ্ধার করা হয়েছে।
খালের কিছু অংশ দখল করে বাণিজ্যিক ভবনটি নির্মাণ করেন স্থানীয় ব্যবসায়ী শাহদাৎ হোসেন। তিনি এলাকায় আওয়ামী লীগের সাংসদ (ঢাকা-১৩) সাদেক খানের ‘ভাতিজা’ হিসেবে পরিচিত। গত বছরের ২ জানুয়ারি ভবনটির উদ্বোধন করেছিলেন সাংসদ সাদেক খান ও ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। উদ্বোধনের এক বছর পর গত ২৩ জানুয়ারি বাণিজ্যিক এ ভবনের অবৈধ অংশ ভেঙে দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, খালের প্রায় দেড় কাঠা পরিমাণ জায়গা দখল করে বিপণিবিতান বানানো হয়েছিল। অবৈধ অংশের তিনটি তলায় প্রায় ২৫টি দোকানের জায়গা ভাঙা পড়ছে। ভবনটি প্রায় ২০ কাঠা জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে।
খাল দখল করে গড়ে ওঠা ভবনের উদ্বোধনের বিষয়ে সাংসদ সাদেক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেখানে একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আর ভবনটির পুরো নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি।’ বছিলায় অনুমোদনহীনভাবে ভবন নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কথা কেউ শোনে না। আমি বাধা দিই, কিন্তু কেউ সেটা মানে না।’
তবে ভবনমালিক শাহদাৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উদ্বোধনের দিন তিনি (সাংসদ) এসেছিলেন, সঙ্গে কাউন্সিলরও ছিলেন। তাঁর দাবি, খালের জায়গা জানলে ভবন তৈরি করতেন না। সাংসদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তিনি (সাংসদ) আমার বাবার বন্ধু। এ কারণেই চাচা ডাকি।’
বাণিজ্যিক ভবনটি যেদিন ভাঙা হয়, সেদিনই ‘একতা’ কাঁচাবাজার উচ্ছেদ করে সিটি করপোরেশন। উচ্ছেদ হওয়া বাজারের একাধিক ব্যবসায়ীর দাবি, বাজারটি খালের জায়গায় ছিল না, এটি ‘হালত’ (ধান শুকানোর জায়গা) হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আওয়ামী লীগের নেতারা ২০১৩ সালে তাদের এখানে বসতে দিয়েছেন। এর কারণ আগে কাঁচা বাজারটি মোহাম্মদপুরে বিআরটিসি বাস ডিপো এলাকায় ছিল। সেখানকার সড়ক চওড়া করার সময় তাদের মৌখিকভাবে এখানে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
উচ্ছেদ হওয়া এ বাজারের নয়জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, বাজার উচ্ছেদ করা হবে না, এমন কথা বলে স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকজন তাঁদের কাছে কিছুদিন আগে চাঁদা চেয়েছিল, কিন্তু তারা চাঁদা দেননি। তাঁদের ধারণা, চাঁদা না দেওয়ায় বাজারটি উচ্ছেদ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন ও রাজউক এ তিন সংস্থা কি তাঁর কথা শুনেই উচ্ছেদ করবে? আর চাঁদা দাবির বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, তিনি বিভিন্ন সময় লোকজনকে দান করে থাকেন, চাঁদা নেবেন কেন।
ওই ব্যবসায়ীদের ‘একতা কাঁচাবাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’ নামে একটি সমিতি রয়েছে। এর সদস্য ২২০ জন। সদস্যরা প্রতি মাসে সমিতিকে ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতেন। এতে বছরে পাঁচ লাখ টাকার বেশি জমা হতো। বাজারের নয়জন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, উচ্ছেদ হওয়ার পর তাঁরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন সমিতির তহবিলে টাকা নেই।
সমিতির সভাপতি এ কে এম অহিদুর রহমান। তিনি মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সমিতির তহবিলে টাকা না থাকা নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাজারের নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মাসের বেতন, বিদ্যুৎ, পানির বিলের পেছনে ওই টাকা খরচ হয়েছে। খরচের হিসাবের অডিট করা আছে। তাঁর দাবি, রাজনৈতিকভাবেই জায়গাটি অসহায় ব্যবসায়ীদের জন্য দেওয়া হয়েছিল।
একতা কাঁচাবাজারে অহিদুর রহমানেরই ছিল ছয়টি দোকান। মোহাম্মদপুর থানা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারজানা হোসেন ও মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মারুফা কাজলের ছিল একটি করে দোকান। ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান ও তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী শাহ আলমেরও একটি করে দোকান ছিল বলে সমিতির নেতারা জানান। নেতারা নিজেদের মালিকানাধীন দোকানগুলো ভাড়া দিয়েছিলেন। মাসিক ভাড়া ছিল দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা।
মোহাম্মদপুর থানা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারজানা হোসেন বলেন, বাজারের জায়গাটি একটি আবাসন কোম্পানি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছিল। সেই কোম্পানিকে রাজনৈতিকভাবে তাঁরা সরিয়েছেন। পরে অসহায় ব্যবসায়ীদের তাঁরা দোকান করতে দিয়েছিলেন।
সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযানে কয়েকজন নেতা–কর্মীকে নিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ফারজানা। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, এ বাজারের আয় থেকে দলের অনেক নেতা–কর্মীর পরিবার চলত। কিন্তু মেয়রকে ভুল বুঝিয়ে বাজারটি উচ্ছেদ করানো হয়েছে।
খাল ভরাট করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক ভবনটির আরেক পাশে অবৈধ ট্রাক টার্মিনাল গড়ে তোলার নেপথ্যেও ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। ট্রাকচালকেরা বলছেন, অবৈধ টার্মিনাল তৈরির পেছনে ছিলেন সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান। তিনি এখন মাদক মামলায় জেলে। আর এ টার্মিনালকেন্দ্রিক ট্রাকচালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল হোসেন। তিনি মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। নাম উদ্ধৃত না হয়ে চারজন ট্রাকচালক বলেছেন, এ টার্মিনাল ট্রাকের পার্কিং ভাড়া এবং আশপাশের দোকানের ভাড়া বাবদ মাসে সাত লাখ টাকার মতো চাঁদা উঠত। তা ভাগাভাগি করতেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং ট্রাকচালক ইউনিয়নের নেতারা।
খালের জায়গায় অবৈধ ভবন, বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে ওঠার বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, দখলের সঙ্গে সব সময় প্রভাবশালীরা জড়িত থাকেন। অধিকাংশ সময় তাঁদের রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া থাকে, নয়তো থাকে অর্থের শক্তি। যেটা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করা হয়। তিনি বলেন, দখলের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা বা যাঁরাই জড়িত থাকুক, তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শুধু উচ্ছেদের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না।