উনিশ শতকের শেষ দিককার কথা। ঢাকার জুবিলী স্কুলের প্রধান শিক্ষক মথুরামোহন চক্রবর্তী হঠাৎ কঠিন অসুখে পড়েন। নানান জায়গায় ঘুরে শেষমেশ বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মচারীর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। পরে তাঁর নির্দেশে মথুরামোহন নিজেই আয়ুর্বেদ চর্চা শুরু করেন। এভাবে ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আয়ুর্বেদ প্রতিষ্ঠান শক্তি ঔষধালয়।
শুরুর গল্পটা বললেন প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক। সম্প্রতি স্বামীবাগে শক্তি ঔষধালয়ের প্রধান কার্যালয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘লোকনাথ বাবা মথুর বাবুকে বলেন, বনে-জঙ্গলে যাও। গাছগাছড়া দিয়ে মানুষের সেবা করো। এভাবেই শক্তির শুরু।’
অধ্যক্ষ মথুরামোহন চক্রবর্তী ‘মথুর বাবু’ নামেই পরিচিত ছিলেন। শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে প্রথম বাংলাবাজারে ওষুধ বিক্রি শুরু করেন। শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ-এ আছে, বিক্রয়লব্ধ আয়ের অর্ধেক তিনি মানবকল্যাণে ব্যয় করতেন। বাকি অর্ধেক দিয়ে নিজের খরচ চালাতেন। মথুর বাবু মারা গেছেন বহুকাল আগে। মৃত্যুর পর তাঁর জ্ঞাতিরা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছিলেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার শক্তি ঔষধালয় অধিগ্রহণ করে। এরপর ১৯৮২ সালে এটি আবার বেসরকারি খাতে চলে যায়। শক্তি ঔষধালয়ের বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, মালিকানা পরিবর্তন হলেও মথুর বাবুর আদর্শ ও তাঁর ওষুধ তৈরির পদ্ধতি অনুসারেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে।
মথুর বাবুর উদ্ভাবিত প্রথম ওষুধ ছিল আমলকীর ক্বাথ দিয়ে তৈরি চ্যবনপ্রাশ। শুরু থেকেই শক্তি ঔষধালয় পাঁচ বৈশিষ্ট্যের ওষুধ তৈরি করে আসছে—তরল টনিক, বড়ি, অর্ধতরল হালুয়া, চূর্ণ আর তেলজাতীয়। আগে এই পাঁচ বৈশিষ্ট্যের ৩০৫টি ওষুধ তৈরি হতো প্রতিষ্ঠানের কারখানায়। এখন ১১৫টি ওষুধ টিকে আছে। গোলাম মোস্তফা বলেন, এখন বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে ঔষধি গাছ চেনার মতো লোকও কমে গেছে। এ রকম নানা কারণে ওষুধের সংখ্যাও কমে গেছে। ১১৫ বছরে ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়াতেও এসেছে পরিবর্তন। যেমন হাতের বদলে যন্ত্রে ট্যাবলেট তৈরি হচ্ছে। রোদের বদলে আধুনিক ড্রায়ারে শুকানো হচ্ছে ওষুধের উপাদান। ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে পরিশোধিত পানি। গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমরা শুধু সিস্টেমকে মডার্ন করেছি। কিন্তু ওষুধের ফর্মুলায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।’
সারা দেশে শক্তি ঔষধালয়ের ৩৫টি শাখা আছে। আর ডিলারদের মাধ্যমে প্রতিটি থানায় তাঁদের ওষুধ বিক্রি হয়। মহাব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক বললেন, তাঁদের সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধগুলোর মধ্যে আছে দাঁতের মাজন ‘দন্তরোগারি’, হজমবর্ধক ‘আমলকী রসায়ন’, বলবর্ধক ‘দশমূলারিষ্ট’। তিনি বললেন, ওষুধগুলোর দামও সবার হাতের নাগালে। মথুর বাবুর লক্ষ্য ছিল কম খরচে মানসম্মত ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া।