শিষ্য–গুরু’ শীর্ষক প্রাচ্যকলা রীতির শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে দর্শকেরা শিল্পকর্ম দেখছেন। গতকাল চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে
শিষ্য–গুরু’ শীর্ষক প্রাচ্যকলা রীতির শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে দর্শকেরা শিল্পকর্ম দেখছেন। গতকাল চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে

গুরু-শিষ্যের পরম্পরা

প্রাচ্যরীতির মনোরম চিত্রকলার প্রদর্শনী জয়নুল গ্যালারিতে

জ্যোৎস্না রাত! এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে সারি দিয়ে বাঁধা নৌকা। পাড় থেকে আরও খানিকটা দূরে আবছায়া গ্রামের রেখা। আলো–আঁধারির এক মায়াবী রহস্যময়তা সৃষ্টি হয়েছে নীরব ঘুমন্ত গ্রামে। জলরঙে প্রাচ্যকলা রীতিতে গ্রামবাংলার এই নয়নাভিরাম দৃশ্য এঁকেছেন শিল্পী অধ্যাপক মলয় বালা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে চলছে প্রাচ্যকলা রীতির শিল্পের যৌথ প্রদর্শনী। সেখানেই রয়েছে ‘চাঁদের আলোয় ঘুমন্ত গ্রাম’ নামের এই চিত্রকলা। ‘গুরু-শিষ্য: শিষ্য-গুরু’ নামের এই প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ৬ সেপ্টেম্বর, চলবে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী খোলা থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রাক্তনীরা এই ধারার চিত্রকলা চর্চার জন্য ২০০৯ সালে গড়ে তোলেন প্রাচ্য-চিত্রকলা অনুশীলন সংঘ। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরা ২০১৫ সালে করেছেন ‘ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টুডিও’। এখানে ‘গুরু–শিষ্য’ রীতির পরম্পরায় নিয়মিত প্রাচ্য–চিত্রকলা চর্চার পাশাপাশি আলোচনা, পাঠচক্র, প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন আয়োজন করা হয়। এসব কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই ‘গুরু-শিষ্য: শিষ্য-গুরু’ শীর্ষক প্রাচ্যকলা রীতির শিল্পকর্ম প্রদর্শনী আয়োজন করে চলছেন তাঁরা। এবার হচ্ছে এই কার্যক্রমের তৃতীয় প্রদর্শনী।

এবারের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন চার শিল্পী। তাঁদের মধ্যে আছেন চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা অনুষদের অধ্যাপক মলয় বালা এবং তাঁর তিন ছাত্র তথা শিষ্য—শিল্পী জাহাঙ্গীর আলম, প্রাচ্যকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অমিত নন্দী ও স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী প্রগতি চাকমা। প্রদর্শনীতে তাঁদের মোট ৫২টি শিল্পকর্ম রয়েছে।

‘গুরু–শিষ্য : শিষ্য–গুরু’ শীর্ষক প্রাচ্যকলা রীতির শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে দর্শকেরা শিল্পকর্ম দেখছেন। গতকাল চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে

গুরু ও শিষ্যরা শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত ধৌতপদ্ধিত অনুসরণ করে জলরঙেই অধিকাংশ চিত্রকর্ম করেছেন। এ ছাড়া আছে কিছু ছাপচিত্র ও ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের কাজ।

শিল্পী মলয় বালা বেশ কয়েকটি গ্রামীণ নিসর্গচিত্র এঁকেছেন। এর মধ্যে আছে ‘আখখেত’, ‘গোধূলি বেলার গ্রাম’। আরও আছে শকুন্তলাসহ বেশ কিছু নারীর প্রতিকৃতি, ময়ূর, লতাগুল্ম—এমন কাজ। এ ছাড়া এস এম সুলতান, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীসহ বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান শিল্পীর প্রতিকৃতিও এঁকেছেন তিনি।

জাহাঙ্গীর আলমের কাজ অনেকটা বিমূর্ত আঙ্গিকের। নর-নারীর আবছা অবয়ব, বর্ষা বসন্তের প্রকৃতি, পরাগায়ণ, অভিসার সুরমূর্ছনার নান্দনিক অভিব্যক্তি ধরার চেষ্টা করেছেন রং–রেখায়। ‘প্রস্ফুটিত আনন্দ’ নামের একটি ছবিতে এঁকেছেন বসন্তে রক্তিম ফুলে ফুলে ভরে ওঠা শাখার দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য।

অমিত নন্দী জলরঙে এঁকেছেন সংগীতের তিন দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন সাঁই ও কাজী নজরুল ইসলাম এক বটবৃক্ষের ছায়াতলে বসে মেতেছেন সংগীত সাধনায়। আরেকটি ছবিতে নজরুল তালিম দিচ্ছেন তাঁর শিষ্যদের। তিনি গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন ছাপচিত্রে। সেখানে দেখা যাচ্ছে তথাগত আদর করছেন হরিণশাবককে, আছেন ধ্যানস্থ অবস্থায়। একটি কাজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও তিনি আছেন এক কাল্পনিক মুহূর্তে।

প্রগতি চাকমার কাজেও আছে বিষয়–বৈচিত্র্য। তিনি চাকমাদের নৃত্য, ম্রোদের উৎসব, পুরান ঢাকায় দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন, চর্যাপদ নিয়ে গানের আসরের মতো বিভিন্ন বিষয় এনেছেন তাঁর কাজে।

প্রাচ্যকলা রীতির শিল্পকর্মের একধরনের মায়াময়, স্নিগ্ধ ব্যঞ্জনা আছে। শিল্পীরা সেই বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখেই পৌরাণিক কাহিনি থেকে শুরু করে বাংলার লোকশিল্প ও সমকালীন জীবনযাত্রার বিভিন্ন অনুষঙ্গ পরস্পরের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। প্রদর্শনীর কাজগুলো শিল্পানুরাগী দর্শকের কাছে উপভোগ্য হবে। প্রশান্তি জাগাবে চিত্তে।