
ঢাকা শহরের পথে তখন কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি ছিল না। দিনের আলো বা রাতের অন্ধকার যা-ই হোক, বাস চলত নিজের গতিতে। ছিল না হর্নের শব্দ। পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের বিহারি লালজি মন্দিরের কাছে প্রথম সিগন্যাল বাতিটি বসল ১৯৬০ সালে।
একই সময় কাছাকাছি বসানো হলো আরও দুটো বাতি। তখন এ শহরের সব ব্যস্ততা সদরঘাট ঘিরে। আজকের পান্থপথের মোড়ে তখন বিশাল খোলা মাঠ আর আশপাশে ছোট ছোট কাঁচা-পাকা বসতির অস্তিত্ব। তখনকার তরুণ, কিশোরেরা প্রথম ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি দেখতে গিয়েছিল উৎসব করে।
সেই গল্প তাদের জীবনে এখনো উজ্জ্বল এক স্মৃতি। তারা আরও বিস্মিত হয়েছিল পুরান ঢাকায় বসানো তিনটি সিগন্যাল বাতিই একটিমাত্র সুইচ দিয়ে জ্বলছে দেখে।
বাতি বসানোর ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে পুরান ঢাকার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক, অনুবাদক হাশেম সূফীর। প্রথম আলোকে বলেন, এই তো সেদিনের কথা, বর্তমান কবি নজরুল কলেজ, তৎকালীন ঢাকা মাদ্রাসার সামনে থেকে ছাড়ত সব ট্যাক্সি আর বাস। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের প্রথম ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির সুইচ চালাতেন একজন ট্রাফিক পুলিশ। খালি চোখে তিন দিক দেখে সিগন্যাল দিতেন তিনি। পোশাক ছিল সাদা রঙের আর মাথায় থাকত শোলার হ্যাট। তৎকালীন মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল এ ব্যবস্থা।
মূলত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে অধুনালুপ্ত লোহারপুলের ঢালে দুর্ঘটনা কমাতে বসানো হয়েছিল ঢাকা শহরের প্রথম ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি। এ পথের বাসভাড়া তখন এক আনা। ছোটদের অর্ধেক ভাড়া মওকুফ।
পরিবহন সেবা তখনো হাতে গোনা। তবে এ পথে বাসসেবা শুরু হওয়ার দুই দশক হয়েছে তত দিনে। দেশভাগের কয়েক বছর আগে, ব্রিটিশ সৈন্যদের ব্যবহার করা ট্রাকের মোটর দিয়ে বানানো হয়েছিল সেসব বাস। স্থানীয় মেকানিকরা মোটরের ওপর কাঠের ফ্রেমের সঙ্গে টিন জুড়ে দিয়ে বানালেন ‘মুড়ির টিন’। ওই নামেই এখনো পরিচিত করিয়ে দেন প্রবীণেরা।
ঢাকা শহরে তখন ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা মেরেকেটে ১৫ থেকে ২০টি। মানুষ বাইসাইকেল আর পদব্রজে অভ্যস্ত। শহরের ভেতর ‘ঠিকা’ বা ‘এক্কা’ নামের ঘোড়ার গাড়ির দাপট আছে তখনো। অন্য জেলার সঙ্গে নৌপথই ছিল প্রধান যাতায়াতব্যবস্থা। তখনো বাস আমদানি শুরু হয়নি। তবে ত্রিশের দশকের শুরু থেকে পুরোনো গাড়ি ব্যবহার করে চলছিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ট্যাক্সি সার্ভিস।
ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির প্রয়োজন জরুরি হলো জনসংখ্যা আর বাসের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়। অধিকাংশ দুর্ঘটনার খবর আসত লোহারপুল ব্রিজ এলাকা ঘিরে। ব্রিজটি উঁচু হওয়ায় এক পাশের বাস অপর দিক থেকে আসা বাহনটিকে দেখতে পেত না। পথে আলোর ব্যবস্থাও ক্ষীণ।
তখন হর্ন মানে চালকের হাতের ভেতর থাকা বেলুনের তৈরি প্যাঁ-পুঁ দেওয়ার যন্ত্র। ফরাশগঞ্জে প্রথম বাতিটি পুল বরাবর বসানোর পর অন্য দুটি বাতি বসানো হয়েছিল সূত্রাপুরের দুই জায়গায়। লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের একটি করে মোট তিনটি বাতি থাকত প্রতি পোস্টে। প্রতিটি পোস্ট নিয়ন্ত্রণ করত একটি করে রাস্তা। এক সুইচ থেকে তিনটি তার মাটির নিচ দিয়ে টেনে সংযোগ করা হয়েছিল বাতির সঙ্গে। ‘দি জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড কলকাতা’র তৈরি ফ্যানের রেগুলেটরের জন্য ব্যবহৃত ‘এবনিজ’-এ বসানো হলো সেই সুইচ।
যেদিকে ঘোরানো হতো তিনটির মধ্যে সেদিকের বাতি জ্বলত। ওপরের নবটি প্লাস্টিকের গোল আর পাটাতন চিনামাটিতে তৈরি। এটি সেট করল কলতাবাজারের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার ঠিকাদার তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর কোম্পানি। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত সুইচ ব্যবহারের জন্য মদনসাহা লেনের গলির মাথায় বানানো ঘরটি ছিল তিন দিকে খোলা আর নিচু ছাদের।
প্রথম ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি জ্বালানোর একমাত্র সুইচটি এখন আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণাকেন্দ্র ‘ঢাকা কেন্দ্র’র জাদুঘরে। ঢাকা কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা আজিম বখশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির জন্য ব্যবহার করা সুইচের প্রয়োজন শেষ হয়েছে সত্তরের দশকের শুরুতেই।
এরপর স্মৃতি হিসেবে আরও কিছু যন্ত্রপাতির সঙ্গে নিজের কাছে রেখেছিলেন তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে তিনি এটি দিয়ে দেন আমাদের। এরপর “ঢাকা কেন্দ্র” শুরু হলে সেখানে সংরক্ষণ করা হয় ঢাকা শহরের ত্রিমুখী ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির জন্য ব্যবহার করা সুইচ।’