ধানমন্ডির সাতমসজিদ প্রধান সড়কসংলগ্ন প্রতিটি আবাসিক এলাকায় রয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল, বিদ্যালয়, খাবারের দোকান
ধানমন্ডির সাতমসজিদ প্রধান সড়কসংলগ্ন প্রতিটি আবাসিক এলাকায় রয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল, বিদ্যালয়, খাবারের দোকান

ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভিড়ে হারাচ্ছে আবাসিকতা 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁর ভিড়ে ধানমন্ডি ও লালমাটিয়ায় প্রায় সারা দিন যানজট লেগে থাকে প্রধান সড়ক, এমনকি অলিগলিতেও। 

ধানমন্ডির মতো বৃহত্তম আবাসিক এলাকায় হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর—সবকিছুই লাগবে। তবে পরিমিত মাত্রায়। সব হতে হবে প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশবান্ধব। বর্তমানে এসবের কিছুই হচ্ছে না। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা তার চরিত্র হারিয়েছে। এখানে যে ভবনগুলোতে হাসপাতাল চালু রয়েছে, সেগুলো মূলত আবাসিক ভবন।

বলছিলেন রাজধানীর ধানমন্ডির ১৪/এ সড়কের স্থায়ী বাসিন্দা, জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান। সম্প্রতি ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে দাঁড়িয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

সকাল-দুপুর, বিকেল-রাত ধানমন্ডিতে যানজট লেগে থাকে প্রধান সড়ক এমনকি অলিগলিতেও। ধানমন্ডির মতো একই চিত্র দেখা গেছে লালমাটিয়াতেও। লালমাটিয়ার আবাসিক ভবনগুলোতে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর ফলে একসময়ের নিরিবিলি আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত লালমাটিয়ায় এখন যানবাহনে গিজগিজ করে। এ দুই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য রয়েছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, নান্দনিক লেক, খেলার মাঠ ও প্রশস্ত রাস্তা। কিন্তু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দাপটে এ দুই আবাসিক এলাকার যে সুনাম, তা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে ধানমন্ডি

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি সাজিদ বিন দোজার লেখা থেকে জানা যায়, ‘এক শতাব্দী আগেও ধানমন্ডি ছিল উলুখাগড়া আর ছনগাছের রাজ্য। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ধানমন্ডি নামের এই প্রান্তিক গ্রামে মানুষজন বসবাস শুরু করে।’

এখন ধানমন্ডি ২৭ ও সাতমসজিদ রোড দিয়ে হাঁটলেই চোখে পড়বে দুই পাশজুড়ে হাসপাতাল, ব্যাংক, রেস্তোরাঁ, কফিশপ, শোরুম—সব মিলিয়ে ধানমন্ডির প্রতিটি বড় রাস্তা যেন একেকটি বাণিজ্যিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। মূল সড়ক দুটির লাগোয়া সড়কেও গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ধানমন্ডির ১৫/এ সড়কে রয়েছে একটি হাসপাতাল। প্রতিদিন অসংখ্য রোগী, রোগীর আত্মীয়স্বজন, ব্যক্তিগত গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ভিড় করে সড়কটিতে।

আবাসিক ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা সীমিত। ফলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ধানমন্ডিতে আসা গাড়িগুলো অলিগলিতে পার্ক করে রাখা হয়েছে। এই চিত্র দেখা গেল ধানমন্ডির ১৪/এ সড়কে এসে। প্রশস্ত সড়কটির এক পাশে মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ওষুধ বিপণনকর্মীরা সকালের গ্রুপ মিটিং রাস্তাতেই সেরে নিচ্ছেন। সড়কটি বেশ প্রশস্ত। সংস্কারকাজ চলছে। গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী জটিলতায় কাজ বন্ধ ছিল দীর্ঘ সময়। এই সড়কটির অপর পাশের ফুটপাত দখল করে চলছে মাছ-মাংস-ভাত-ডাল রান্নার কাজ। সড়কে পাতা হয়েছে টেবিল। খোলা পরিবেশে ধুলাবালুর মধ্যে রোগীর আত্মীয়স্বজন খোলা বাংলা হোটেলে পেটের ক্ষুধা মেটাচ্ছেন। সড়কটিতে একটি মেডিকেল কলেজ, একটি ডেন্টাল কলেজ, একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রয়েছে।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে অবস্থিত এবি ব্যাংকের পাশের সড়কটির নম্বর ১৬। এই সড়কে নামফলকহীন পাশাপাশি দুটি পুরোনো দ্বিতল বাড়ি এখনো টিকে আছে। বাড়ি দুটির আঙিনায় এখনো কিছু গাছপালা দেখা যায়। কিন্তু নতুন বহুতল ভবনগুলোতে ফাঁকা জায়গা বা সবুজের অস্তিত্ব নেই। আশির দশকেও ধানমন্ডির প্রতিটি প্লটে এ রকম একটি করে সুন্দর একতলা বা দোতলা বাড়ি ছিল।

ইতিহাসবিদ ও গবেষক মুনতাসীর মামুনের বিখ্যাত গ্রন্থ ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী থেকে জানা যায়, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার গোড়াপত্তন হয় ১৯৪৮-৪৯ সালে, পাকিস্তান আমলে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধিগ্রহণে এটি ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে ওঠে।

লালমাটিয়া আবাসিক এলাকাকে কেন্দ্র করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও খাবারের দোকানে রমরমা ব্যবসা চলছে

লালমাটিয়ার যত্রতত্র স্কুল

লালমাটিয়া নিয়ে হতাশার কথা জানালেন বাংলা একাডেমির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জালাল আহমেদ। তিনি লালমাটিয়া সি-ব্লকের স্থায়ী বাসিন্দা। অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা বলেন, ‘লালমাটিয়াজুড়ে যত্রতত্র স্কুল খোলা হয়েছে। এখানে কোনো বাণিজ্যিক প্লট নেই। তারপরও প্রায় প্রতিটি সড়কেই একটি-দুটি করে দোকানপাট গড়ে উঠছে। পুরো ঢাকা থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসছে, সঙ্গে অভিভাবক। এর ফলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লালমাটিয়ায় মানুষ, ব্যক্তিগত যানবাহন, ‘ভয়ংকর’ অটোরিকশাগুলোর দাপটে রাস্তায় পা ফেলাই দায়।

লালমাটিয়ার গলিপথ ঘুরে তাঁর কথার সত্যতা পাওয়া গেল। বি-ব্লকের ২, ৪, ৬ ও ৭ নম্বর রোডে আবাসিক ভবনেই খোলা হয়েছে বিদ্যালয়! বহুতল ভবন ভাড়া নিয়ে তিন-চার কক্ষের ফ্ল্যাট বাড়িতে চলছে স্কুল।

লালমাটিয়া আবাসিক এলাকায় মাঠ রয়েছে তিনটি। ডি ও সি ব্লকের মাঠটিতে স্থানীয় বাসিন্দারা খেলাধুলার সুযোগ পেলেও এ ব্লকে আড়ংয়ের পাশের মাঠটিতে প্রায় দুই বছর ধরে সংস্কারকাজ চলছে। মাঠটি টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ভেতরে সংস্কারকাজের জন্য আনা বালু মাঠজুড়ে উঁচু ঢিবি হয়ে আছে।

আইন কী বলে

আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিকীকরণ ঠেকাতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার প্লটগুলোতে নির্দিষ্ট কার্যক্রমের বাইরে বাণিজ্যিক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০২৩ খসড়ায় বলা আছে, কোনো ইমারত/স্থাপনা বসবাস বা ব্যবহারের সনদপত্রে উল্লেখিত ব্যবহারের উদ্দেশ্যবহির্ভূত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অন্যথায় ইমারত নির্মাণ আইন ও অন্যান্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এস এম শফিকুর রহমান বলেন, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজাউক) ইতিমধ্যে ৩ হাজার ১৯২টি অবৈধ ভবন চিহ্নিত করেছে। এই অবৈধ ভবনগুলোর উচ্ছেদ কার্যক্রম রাজাউক শুরু করবে। আবাসিক এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ যে কোন বাণিজ্যিক কার্যক্রম আমরা নীতিগতভাবে ঠিক মনে করি না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তৈরি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ অনুযায়ী আবসিক এলাকায় অনুমোদিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ট্যাক্স আদায় কার্যক্রম আমরা গতিশীল করার চেষ্টা করছি।’