
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন একমাত্র স্থায়ী গাবতলীর পশুর হাট ইজারার জন্য সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকা দর পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বানের পর গতকাল বুধবার বিকেলে দরপত্র খোলা হয়। গাবতলী হাটে সর্বোচ্চ দর দিয়েছে টিএইচ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ট্রেড লাইসেন্স অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির মালিক আলী হায়দার নামের এক ব্যক্তি।
তবে টিএইচ এন্টারপ্রাইজের দরপত্র জমাদানের প্রক্রিয়া এবং দরপত্রে ত্রুটি থাকার অভিযোগ তুলে তাৎক্ষণিক নগর ভবনে হট্টগোল করেছেন অন্য দরদাতাদের প্রতিনিধিরা। এ সময় টিএইচ এন্টারপ্রাইজের কাউকে সেখানে পরিচয় দিতে দেখা যায়নি। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হাট ইজারার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
গাবতলী হাট ইজারার জন্য প্রথম দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল গত ৩ মার্চ। ১৯ মার্চ বিকেলে দরপত্র খুলে পাঁচটি দরপত্র পাওয়া গিয়েছিল। সরকারনির্ধারিত মূল্য ১৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৯ হাজার ৩০০ টাকার বিপরীতে তখন সর্বোচ্চ দর পাওয়া গিয়েছিল সোয়া ২২ কোটি টাকা।
তবে দরপত্র প্রক্রিয়ায় ভুল থাকার কথা উল্লেখ করে তখন হাটটি ইজারা দেননি ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই হাটে এখন পর্যন্ত খাস বা সিটি করপোরেশনের নিজ উদ্যোগে অর্থ আদায় চলছে।
গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা উত্তর সিটির নগরভবনের ষষ্ঠতলায় গাবতলী হাটের দরপত্র খোলা হয়। হাট ইজারা পেতে দরদাতা ও তাদের প্রতিনিধিদের সামনে হাটের ইজারা প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জমা দেওয়া শিডিউল খুলে দর ঘোষণা করেন ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।
প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা জানান, গাবতলী হাটের জন্য চারটি দরপত্র জমা পড়েছে। এর মধ্যে এরফান ট্রেডার্স দর দিয়েছেন ১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। পে-অর্ডার জমা দিয়েছেন সাড়ে সাত কোটি টাকার। দ্বিতীয় দরপত্রটি ছিল রাইয়ান এন্টারপ্রাইজের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কোনো দর উল্লেখ করেনি, পে-অর্ডারও জমা দেয়নি।
এরপর টিএইচ এন্টারপ্রাইজের দেওয়া দর ঘোষণা করা হয়। দর পাওয়া যায় ২৫ কোটি টাকা। সঙ্গে ছিল সাড়ে সাত কোটি টাকার পে-অর্ডার। আর শেষের দরপত্রটি ছিল আকাশ ট্রেডিংয়ের। এ প্রতিষ্ঠানটিও কোনো দর উল্লেখ করেনি, পে-অর্ডারও জমা দেয়নি।
টিএইচ এন্টারপ্রাইজের দেওয়া দর ঘোষণার পরই সেখানে উপস্থিত থাকা অন্য দরদাতাদের প্রতিনিধিরা হট্টগোল শুরু করেন। তাঁরা জানতে চান, এ দরপত্র কোথায় জমা দেওয়া হয়েছিল? জবাবে দর ঘোষণাকারী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ জানান, ‘এখানেই (প্রধান কার্যালয়ে সম্পত্তি বিভাগে) জমা হয়েছে।’
অন্য দরদাতাদের প্রতিনিধিরা এ জবাবের বিরোধিতা করেন। তখন মঞ্চে থাকা পাশের একজন নারী কর্মকর্তাও আবদুল্লাহর ওই কথায় সায় দিয়ে বলেন, ‘না না, এখান থেকেই (সম্পত্তি বিভাগের দরপত্র বাক্স থেকে) বের করা হয়েছে।’ কিন্তু অন্য দরদাতাদের প্রতিনিধিরা আবারও সেখানে ওই দরপত্র জমা হয়নি দাবি করে প্রতিবাদ জানান।
একপর্যায়ে আবদুল্লাহ ওই জায়গায় উপস্থিত সম্পত্তি বিভাগের কর্মীদের কাছে জানতে চান, ‘অঞ্চল থেকে দুইটা দরপত্র এসেছে। কোন দুইটা অঞ্চল থেকে এসেছে?’ কর্মীদের উত্তর স্পিকারে শোনা যায়নি। পরে কর্মীদের কাছে জেনে আবদুল্লাহ বলেন, ‘অঞ্চল-২’। এরপর তিনি দরদাতাদের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, ‘অঞ্চল থেকেও “ইনটেক” অবস্থায় আসে। এটাও সেভাবে এসেছে।’
এরপরই প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আকাশ ট্রেডিংয়ের দরপত্র ঘোষণা করেন। শেষে তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের মূল্যায়ন কমিটির সভা হবে। সভায় সিদ্ধান্ত হবে।’
প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার এ ঘোষণার পর উপস্থিত অন্য দরদাতাদের প্রতিনিধিরা টিএইচ এন্টারপ্রাইজের পে-অর্ডারের কপি দেখতে চান। পাশাপাশি উচ্চ স্বরে টিএইচ এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি কেউ আছেন কি না, সেটা জানতে চান। কিন্তু ওই সময় কোনো ব্যক্তিকে টিএইচ এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিতে দেখা যায়নি।
এ ছাড়া করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে আসা শিডিউলগুলো খোলামেলাভাবে আসে, টেন্ডার বক্সে আসে না—এসব অভিযোগ তুলে প্রতিনিধিরা হট্টগোল করতে থাকেন।
ঢাকা উত্তর সিটির রাজস্ব বিভাগ থেকে টিএইচ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া গেছে। এর মালিক আলী হায়দার নামের এক ব্যক্তি। তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানা মিরপুর ১০/এ, রোড-৫, প্লট-১। আর মালিকের ঠিকানা ইব্রাহিমপুরের আদর্শ পল্লির ১৪০/১ নম্বর বাসা।
এ ছাড়া টিএইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক আলী হায়দারের নামে আরেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটিতে। প্রতিষ্ঠানটির নাম এইচএল মোটরস। ঠিকানা মিরপুর ১০/এ-তেই। তবে রোড ও প্লট নম্বর আলাদা। এইচএল মটরসের বাণিজ্যিক ঠিকানা রোড-৪, প্লট-২। এ দুটি ট্রেড লাইসেন্সেই মালিক আলী হায়দার, বাবা-মায়ের নামও এবং স্থায়ী ঠিকানা একই।
দুটি ট্রেড লাইসেন্সেই আলী হায়দারের মুঠোফোন নম্বর একই। তবে বুধবার বিকেল থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত ওই মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। ইজারাপ্রত্যাশী অন্য দরদাতাদের প্রতিনিধিরাও টিএইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক আলী হায়দারকে চিনতে পারছেন না। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না, তা মিরপুরের স্থানীয় বিএনপি নেতারা জানাতে পারেননি।
দ্বিতীয় পর্যায়ের দরপত্র প্রক্রিয়ায় দরপত্র দাখিল করেছিল চারটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে টিএইচ এন্টারপ্রাইজ ছাড়া মাত্র আরেকটি প্রতিষ্ঠান হাটের জন্য দর দিয়ে পে-অর্ডার জমা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে এরফান ট্রেডার্স। এর মালিক দারুস সালাম থানা বিএনপির আহ্বায়ক এস এ সিদ্দিক (সাজু)। প্রতিষ্ঠানটি দর দিয়েছে ১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সঙ্গে সাড়ে সাত কোটি টাকার পে-অর্ডার জমা দিয়েছেন।
এরফান ট্রেডার্সের একজন প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্র খোলার কার্যক্রম শেষে তাঁরা ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সংস্থাটির সচিব মুহাম্মদ আসাদুজ্জামানের দপ্তরে গিয়েছিলেন। সেখানে টিএইচ এন্টারপ্রাইজের জমা দেওয়া দরপত্রের বিভিন্ন ত্রুটি ওই কর্মকর্তাকে তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন।
ওই প্রতিনিধির দাবি, টিএইচ এন্টারপ্রাইজের প্রয়োজনীয় নথিপত্রে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার সত্যয়ন নেই। এ ছাড়া যেখানে প্রতিষ্ঠানের মালিকের স্বাক্ষর করার কথা, সেখানে স্বাক্ষর নেই। দর দেওয়ার জায়গায় পে-অর্ডারের মূল্য বসানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বুধবার রাতে প্রথম আলোকে মুঠোফোনে এস এ সিদ্দিক জানান, সর্বোচ্চ দরদাতা ওই প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র এখনো যাচাই-বাছাই হয়নি। করপোরেশনের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি আগামীকাল (আজ বৃহস্পতিবার) এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। তখন জানা যাবে হাটের ইজারা কারা পাচ্ছেন। এ ছাড়া আলী হায়দারের পরিচয় কী, তারা এখনো সেটা জানতে পারেননি বলেও জানান তিনি।
ইজারা প্রক্রিয়ায় ত্রুটি দেখিয়ে প্রথম পর্যায়ের সর্বোচ্চ দরদাতা মেসার্স আরাত মোটরকে ইজারা দেওয়া হয়নি। ওই দরপত্রে সিদ্দিকের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ সাইদুল ইসলামের রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ তৃতীয় সর্বোচ্চ দর দিয়েছিল।
অভিযোগ রয়েছে, পছন্দের ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ দরদাতা না হওয়ায় করপোরেশন খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও পরোক্ষভাবে হাটের হাসিল আদায়ের কাজ করছিলেন সিদ্দিকের প্রতিনিধিরা। এতে সর্বোচ্চ দরের হিসেবে করপোরেশনের দৈনিক যে টাকা আয় হতো, এর থেকে অনেক কম টাকা আয় হচ্ছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মুহাম্মদ আসাদুজ্জামানের মুঠোফোন নম্বরে বুধবার রাতে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত গাবতলী হাটের ইজারা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।