কোচ বাড়াতে জটিলতা, তাই যাত্রীর চাপ সামলাতে মেট্রোরেলে বাড়ানো হচ্ছে ট্রেন চলাচলের সংখ্যা।
প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল যাত্রী চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনে মেট্রোরেলে আরও দুটি কোচ যুক্ত করা হবে। সেভাবে স্টেশনের দৈর্ঘ্যও ঠিক হয়। কিন্তু বাড়তি খরচ ও কারিগরি জটিলতার কারণে নতুন কোচ যুক্ত করা যাচ্ছে না। এর পরিবর্তে বাড়ানো হচ্ছে ট্রেনের সংখ্যা।
এখন মেট্রোরেলে ছয়টি কোচ নিয়ে প্রতিটি ট্রেনের সেট গঠিত। প্রতি ট্রেনের দুই প্রান্তে থাকে দুটি ট্রেলার কোচ (যেখানে চালক বসেন, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকে, যাত্রী বহনও হয়) এবং মাঝখানে চারটি মোটর কোচ (পুরোটাই যাত্রী বহন হয়) থাকে। মেট্রোরেলে এমন সেট রয়েছে ২৪টি। এর সব কটি ব্যবহার হচ্ছে না।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, নকশা অনুযায়ী ট্রেনের ছয়টি কোচের প্রতি সেটে গাদাগাদি করে ২ হাজার ৩০০ যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব। প্রতিটি সেটে আরও দুটি কোচ সংযোজন করা গেলে একই লোকবল দিয়ে বাড়তি হাজারখানেক যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব। জ্বালানি খরচও বেশি হবে না। আরেকটি বিকল্প হলো ট্রেন চলাচলের সংখ্যা (ট্রিপ) বাড়ানো। তবে এতে বাড়তি জনবল ও জ্বালানি খরচ হবে।
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে আছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সংস্থাটির হিসাবে, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে চার লাখের বেশি যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন। এর মধ্যে গত ৬ আগস্ট সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহন ছিল, ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৬। প্রতিটি ট্রেনে গড়ে দুই হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। এর চেয়ে বেশি যাত্রী বর্তমান ব্যবস্থা দিয়ে পরিবহন করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
নতুন লোকবল নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। প্রশিক্ষণে কিছু সময় লাগবে। দু-এক মাসের মধ্যেই ট্রেনের চলাচল (ট্রিপ) বাড়ানো হবে।ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নতুন করে বিনিয়োগ করা কঠিন। এখন ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। নতুন লোকবল নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। প্রশিক্ষণে কিছু সময় লাগবে। দু-এক মাসের মধ্যেই ট্রেনের চলাচল (ট্রিপ) বাড়ানো হবে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু। প্রথমে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল করে। ২০২৩ সালে ডিএমটিসিএলের তৎকালীন এমডি এম এ এন সিদ্দিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁরা ভবিষ্যতে ট্রেনের প্রতিটি সেটে আরও দুটি কোচ যুক্ত করবেন।
■ প্রতিটি ট্রেনে ছয়টি কোচ রয়েছে। ■ আট কোচে রূপান্তরে প্রযুক্তিগত জটিলতা। ■ প্রতিদিন গড়ে চার লাখ যাত্রী পরিবহন। ■ অব্যবহৃত রয়েছে সাত সেট ট্রেন।
যাত্রা শুরুর এক বছর পর নভেম্বরে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয়। এতে যাত্রী চাপ আরও বেড়ে যায়। গত বছরের শুরুতে যাত্রীদের সুবিধার্থে, ট্রেনের গতি ও সময়সূচি ধরে রাখার লক্ষ্যে দুটি কোচ যুক্ত করার বিষয়ে উদ্যোগ নেয় ডিএমটিসিএল।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, ডিএমটিসিএলের নতুন এমডি ফারুক আহমেদ গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন দুটি কোচ যুক্ত করার বিষয়টি সামনে আনেন। এরপর জাপানের সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ঠিকাদার জানিয়েছে, দুটি কোচ যুক্ত করতে হলে নতুন করে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া সময়ও লাগবে অনেক। ফলে কোচ বৃদ্ধির বিষয়টি আটকে যায়। তবে ভবিষ্যতে ঢাকায় যত মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ হবে, সব কটিতেই আটটি কোচের সমন্বয়ে সেট তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের পথটি লাইন-৬ নামে পরিচিত। কমলাপুর পর্যন্ত চালু হতে আরও দেড় থেকে দুই বছর লাগবে। বর্ধিত অংশে এখন কাজ চলছে।
প্রকল্পের সমীক্ষা অনুসারে, ২০৩০ সাল নাগাদ মেট্রোরেলের যাত্রী বেড়ে গেলে ছয় কোচ দিয়ে চাহিদা মেটানো যাবে না। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই যাত্রী বেড়ে গেছে।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, পরামর্শক ও প্রকল্প কর্মকর্তারা এত দিন বলে আসছেন বাড়তি যাত্রীর চাহিদা মেটাতে যেকোনো সময় প্রতি ট্রেনে দুটি কোচ যুক্ত করা যাবে। বর্তমানে মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোর সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্য ১৭০ মিটার। এই দৈর্ঘ্যের প্ল্যাটফর্মে আরও দুটি কোচের জায়গা দেওয়া সম্ভব। এখন ট্রেন (ছয় কোচের) প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালে পেছনে আরও দুটি কোচের জায়গা ফাঁকা থাকে। এই জায়গা স্টিলের অস্থায়ী বেড়া দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।
বিপুল টাকায় নির্মিত মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রী বাড়লে যেমন আয় বাড়বে, তেমনি সড়কেও চাপ কমবে। নতুন কোচ জোড়া লাগানো না গেলে ট্রেনের চলাচল (ট্রিপ) বাড়িয়ে দিতে হবে।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক
অবশ্য প্ল্যাটফর্মে জায়গা রাখা হলেও সংকেতব্যবস্থা বসানো হয়নি। এখন ছয়টি কোচের জন্য প্ল্যাটফর্মে প্রয়োজনীয় দরজা রয়েছে। বাড়তি কোচের জন্য দরজা বসানো হয়নি। ১৭টি স্টেশনেই এভাবে নতুন করে দরজা বসাতে হবে। এর বাইরে বিদ্যুৎ–ব্যবস্থার সঙ্গে সংযোগ করারও একটা জটিলতা রয়েছে।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, বর্তমানে ২৪ সেট ট্রেনের মধ্যে সার্বক্ষণিক লাইনে চলাচল করে ১৩টি। তিন সেট ট্রেন বিশেষ প্রয়োজনে লাগতে পারে, এই বিবেচনায় প্রস্তুত রাখা হয়। লাইন ও সংকেত ব্যবস্থা পুরোপুরি ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করার জন্য সকালে একটি ট্রেন যাত্রী ছাড়াই চলে। বাকি সাত সেট ট্রেন অব্যবহৃত থাকে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল টাকায় নির্মিত মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রী বাড়লে যেমন আয় বাড়বে, তেমনি সড়কেও চাপ কমবে। নতুন কোচ জোড়া লাগানো না গেলে ট্রেনের চলাচল (ট্রিপ) বাড়িয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া মেট্রোরেলের চলাচলের সময় রাতে কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে।