রাজধানীর অনেক এলাকাতেই পথচারীদের দুশ্চিন্তার একটা বড় কারণ ছিনতাই। বিশেষ করে সন্ধ্যায়, রাতে ও ভোরে এই আশঙ্কা বেশি থাকে। এর মধ্যে সড়কে অপরাধীদের মহড়া, কুপিয়ে জখম ও ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে সর্বস্ব লুটে নেওয়ার বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ পাওয়ার পর জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে। এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যেও গত তিন মাসে ঢাকায় ছিনতাই মামলার ১ হাজার ১০৮ আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে ৪২৫ জন, জুনে ৩০৫ জন এবং জুলাইয়ে ৩৭৮ জন ছিনতাই মামলার আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ঢাকার আদালত থেকে। তাঁরা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানার ১ হাজার ৫৮টি মামলায় আসামি ছিলেন।
পুলিশ বলছে, জামিন পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কারও সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। কেউ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবার তদন্তে নাম আসার পর গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেকে। ছিনতাইয়ের প্রস্তুতিকালে ও সন্দেহভাজন ছিনতাইকারী হিসেবেও গ্রেপ্তার হয়েছেন কেউ কেউ। এমনকি শেষে আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে নাম রয়েছে, এমন আসামিরও জামিন হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সুযোগ নিয়ে রাজধানীর অনেক এলাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। এ সময় ছিনতাইকারীদের হাতে মানুষ খুন হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গত ২১ এপ্রিল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন মো. আরমান হোসেন (২২) নামের এক তরুণ। পরিবার জানায়, ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয়।
ছিনতাইকারীবিরোধী অভিযান চালিয়ে অপরাধী গ্রেপ্তারের পর শাস্তি নিশ্চিতে পুলিশের দিক থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আদালতে প্রসিকিউশন শাখা ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণপুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম
আদালত সূত্র জানায়, এর আগে গত বছরের আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজধানীতে ছিনতাইকারীর হাতে সাতজন খুনের ঘটনা ঘটেছে।
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঢাকার অনেক পাড়া-মহল্লায় মানুষ রাত জেগে পাহারাও বসিয়েছিল। পরে পুলিশি কার্যক্রম কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে ছিনতাইকারীবিরোধী অভিযানও শুরু হয়। পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীও অভিযান জোরদার করে। বিভিন্ন এলাকায় অনেক ছিনতাইকারী, দুর্বৃত্ত গ্রেপ্তার হতে থাকে।
ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করে অপরাধী ধরা হচ্ছে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অনেকে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার ছিনতাইয়ে যুক্ত হচ্ছে। ফলে একই অপরাধীর পেছনে বারবার ছুটতে হচ্ছে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র বলছে, মাঠপর্যায়ের সদস্যদের থেকে বিভিন্ন সময় অভিযোগ আসছিল যে জামিনে মুক্ত হয়ে ছিনতাইকারীরা আবার অপরাধে জড়াচ্ছে। এরপর থেকে প্রতি মাসে ছিনতাইয়ের মামলাগুলো বিশেষভাবে তদারক করা হচ্ছিল। মামলা ও গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জামিনের হিসাবও রাখতে শুরু করে পুলিশ। তাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসামির জামিনে বেরিয়ে আসার বিষয়টি উঠে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছিনতাইকারীবিরোধী অভিযান চালিয়ে অপরাধী গ্রেপ্তারের পর শাস্তি নিশ্চিতে পুলিশের দিক থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আদালতে প্রসিকিউশন শাখা ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।’ এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পুলিশের সংশ্লিষ্ট শাখাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে আইজিপি জানান।
ছিনতাইকালে হাতেনাতে ধরা হলে অথবা পুরোনো আরও মামলা থাকলে সাধারণত সেসব আসামির জামিন হয় না। তবে সন্দেহভাজন হিসেবে যাঁরা গ্রেপ্তার হন, তাঁদের তো বছরের পর বছর আটকে রাখা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয় মাস পর তাঁদের জামিন হয়।ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী
প্রচলিত আইনে ছিনতাইয়ের ঘটনায় দস্যুতা ও ডাকাতির ধারায় মামলা হয়। আসামির সংখ্যা এক থেকে চারজন হলে দস্যুতা এবং চারজনের বেশি হলে তা ডাকাতি হিসেবে গণ্য হয়।
পুলিশ সূত্র বলছে, গত তিন মাসে যাঁরা জামিন পেয়েছেন, তাঁদের বড় অংশ ছিনতাইয়ের অভিযোগে করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি। অর্থাৎ, সুনির্দিষ্ট অপরাধ ও নাম উল্লেখ করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যেমন জুলাইয়ে যে ৩৭৮ জনের জামিন হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১৪৮ জনই এজাহারভুক্ত আসামি। ১৯৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সন্দেহভাজন হিসেবে। একজন ছিলেন মামলার তদন্তে তাঁর নাম এসেছিল। বাকি ৩১ জনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
এর আগের দুই মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মে মাসে জামিন পাওয়া ৪২৫ জনের মধ্যে সন্দেহভাজন আসামি ২১৫ জন। এজাহারভুক্ত আসামি ১৩১ জন এবং তদন্তে সম্পৃক্ততা পাওয়ার পর গ্রেপ্তার হন ১৬ জন। ৬৩ জনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। জুনে জামিনপ্রাপ্ত ৩০৫ জনের মধ্যে ১৫০ জনই এজাহারভুক্ত আসামি।
এর মধ্যে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিও রয়েছেন। যেমন গত ২০ মার্চ উত্তরা পশ্চিম থানা-পুলিশ আবদুল্লাহপুরে ছিনতাই-ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ফ্লাইওভারের ওপর অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে চাপাতি, ছুরি ও চাকু উদ্ধার করা হয়। তদন্ত শেষে এই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। এই অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের একজন রুবেল মিয়ার (২৩) গত মাসে জামিন হয়েছে।
অপরাধ অনুযায়ী মামলা না নিয়ে দুর্বল ধারায় মামলা হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও নজর দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রমাণ মিললে দ্রুততম সময়ে অভিযোগপত্র দিতে বলা হয়েছে।
আইনজীবীরা বলছেন, মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত জামিন পাওয়া আটকানো কঠিন। অপরাধের মাত্রা যা-ই হোক, বিচার না হওয়া পর্যন্ত জামিন নাগরিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে প্রকৃত অপরাধীদের কীভাবে সাজা নিশ্চিত করা যায়, সেটাই চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকৃত অপরাধীদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতে প্রসিকিউশন শাখা বা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁরা জামিনের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কতটা যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, সেটাও বিবেচ্য বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত আসামির জামিনের বিরোধিতায় আদালতে শক্তভাবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয় না, এমন অভিযোগও আছে।
আবার পুলিশও সঠিক ধারায় মামলা না দিয়ে ছিনতাইকারী ধরে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়, অপরাধের বিষয়টা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয় না; এমন অভিযোগও রয়েছে। তার ওপর এ ধরনের মামলার তদন্তে ধীরগতির উদাহরণও কম নয়। এ বিষয়গুলো তদারক করতে নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। অপরাধ অনুযায়ী মামলা না নিয়ে দুর্বল ধারায় মামলা হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও নজর দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রমাণ মিললে দ্রুততম সময়ে অভিযোগপত্র দিতে বলা হয়েছে।
আবার পুলিশও সঠিক ধারায় মামলা না দিয়ে ছিনতাইকারী ধরে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়, অপরাধের বিষয়টা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয় না; এমন অভিযোগও রয়েছে।
গত ১৫ এপ্রিল ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের এক আদেশেও মামলার দুর্বলতার বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে তিনি বলেন, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু মামলা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামিদের সন্দেহভাজন হিসেবে অজ্ঞাতনামা আসামি থাকা মামলায় ‘ফরোয়ার্ড’ (আদালতে পাঠানো) করা হয়। আসামিরা যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সে বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা বা ব্যাখ্যা অনেক মামলায় দেওয়া হয় না, যা আসামিদের জামিন পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাইকালে হাতেনাতে ধরা হলে অথবা পুরোনো আরও মামলা থাকলে সাধারণত সেসব আসামির জামিন হয় না। তবে সন্দেহভাজন হিসেবে যাঁরা গ্রেপ্তার হন, তাঁদের তো বছরের পর বছর আটকে রাখা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয় মাস পর তাঁদের জামিন হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, ছিনতাইয়ের মামলাগুলোর তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিতে গড়ে ন্যূনতম এক বছর লেগে যায়। এরপর বিচার শুরু হলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে। এর আগের কাজটা মূলত পুলিশের। এ জন্য সঠিক অভিযোগ লিখে ঠিক ধারায় মামলা করা এবং দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া জরুরি।