প্রথম আলোর অনুসন্ধান

শিশুর ভুয়া জন্ম–মৃত্যু দেখিয়ে নিবন্ধনের লক্ষ্যপূরণ

রোমান আহমেদ ও মোসাম্মত মৌসুমি ইসলাম স্বামী-স্ত্রী। তাঁদের বাড়ির খোঁজে আমরা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছিলাম।

রোমানের বাবার নাম গোলাপ মিয়া, মায়ের নাম খাদিজা বেগম। ঠিকানা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের সাদেকপুর গ্রাম। ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন তথ্যে রোমানের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে এটাই লেখা। তাঁদের তথ্য, সম্প্রতি রোমান ‘ডায়াবেটিসের কারণে মারা’ গেছেন।

অনেক খুঁজেও সাদেকপুর গ্রামের কারও কাছে রোমানের বাড়ির হদিস পাওয়া গেল না। শেষ চেষ্টা হিসেবে জন্মনিবন্ধনের তথ্য যাচাই করতে ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’-এর https://everify.bdris.gov.bd/ সিস্টেমে প্রবেশ করে রোমানের জন্মনিবন্ধন নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে আসল ঠিকানা পাওয়া গেল, যা একই ইউনিয়নের বিরামপুর গ্রামে। এবার বিরামপুর গ্রামে গিয়ে সহজেই পাওয়া গেল রোমানের পরিবারকে। পাকা বাড়ির দরজায় গিয়ে ডাকতেই বেরিয়ে এলেন রোমানের মা খাদিজা বেগম। ঘটনাটি গত ১১ নভেম্বরের।

রোমান আহমেদকে কেন আমরা খুঁজছি, তা বলার আগে তাঁর সম্পর্কে একটু জানানো প্রয়োজন। ইউপির তথ্য অনুসারে, রোমানের বয়স ১৯ বছর, মৌসুমির ১৮। এই দম্পতির ১৯ সন্তান। ১৯তম সন্তান সাচ্চু জারিফের জন্ম হয় এ বছরের ১০ অক্টোবর। সন্তানসংখ্যা দেখে আপনি বিস্মিত? তাহলে ধৈর্য ধরে আরেকটু পড়ুন।

ইউপির তথ্য বলছে, সাচ্চু জারিফের মৃত্যু হয় জন্মের ৪০ দিন পর ৯ নভেম্বর। তার জন্মের দিন (১০ অক্টোবর, ২০২৫) ১৩ নম্বর সন্তান মিতু মনি এবং ১৮ নম্বর সন্তান মিলি মনিরও জন্ম হয়। মিতুর মৃত্যু হয় গত ৯ নভেম্বরে এবং মিলির মৃত্যু হয় গত ৩০ অক্টোবর।

তিনটি শিশুরই মৃত্যু ‘কার্ডিওজেনিক শকে (হৃদ্‌রোগ)’। তিন সন্তানের জন্মের আগের দিন মৃত্যু হয় বাবা রোমানের। আর দুই সন্তানের জন্মের দিন ১০ অক্টোবর মৃত্যু হয় মা মৌসুমির। এক সন্তানের জন্ম হয় তাঁর মৃত্যুর পর।

১৮ বছর বয়সী মায়ের ১৯ সন্তান, মায়ের মৃত্যুর ২০ দিন পর সন্তান জন্ম—এসব শুনে আপনার হয়তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়েছে। তবে জেনে রাখুন, এসব বাংলাদেশের সরকারি তথ্যভান্ডারের তথ্য এবং পুরোটাই ভুয়া। তথ্যভান্ডারটি রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের।

মানুষের জন্ম-মৃত্যুর তথ্য নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে ইচ্ছেমতো শিশুদের জন্মের তথ্য দেখানো হচ্ছে। তারপর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তাদের মৃত্যুর তথ্য দেখা হচ্ছে। কারণ, ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের লক্ষ্যপূরণের চাপ থাকে। পাশাপাশি লক্ষ্য পূরণ করলে পাওয়া যায় স্বীকৃতি। এ কারণে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। সেটার প্রমাণ ‘রোমান ও মৌসুমি দম্পতির’ ঘটনাটি।

ইউপির তথ্য অনুসারে, রোমানের বয়স ১৯ বছর, মৌসুমির ১৮। এই দম্পতির ১৯ সন্তান। ১৯তম সন্তান সাচ্চু জারিফের জন্ম হয় এ বছরের ১০ অক্টোবর। সন্তানসংখ্যা দেখে আপনি বিস্মিত? তাহলে ধৈর্য ধরে আরেকটু পড়ুন।

নিয়ম অনুসারে, অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য আবেদন করার পর আবেদনকারী সনদের জন্য ইউপির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা ইউপি সচিবের কাছে আসেন। এখানে ইউপি সচিব সহকারী নিবন্ধক আর ইউপি চেয়ারম্যান নিবন্ধক। ইউপি সচিব রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সিস্টেমে প্রবেশ করেন এবং আবেদনকারীর তথ্য যাচাইয়ের পর অনলাইনে নিবন্ধন ফি পাঠিয়ে (আবেদনকারীর দেওয়া টাকা) গ্রহণ করেন। তারপর নিবন্ধক বা চেয়ারম্যান তাঁর আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে নিবন্ধন করেন। চেয়ারম্যান অনুমোদন দেওয়ার পর ইউপি সচিব তাঁর আইডি থেকে জন্ম ও মৃত্যুসনদ প্রিন্ট করে আবেদনকারীকে দেন।

রোমান ইউপি থেকে সনদ নেওয়ার পর তাঁর জন্মনিবন্ধনের নম্বর ও জন্মতারিখ ব্যবহার করে তাঁর অজান্তে ইউপি কার্যালয় থেকে কাল্পনিক দম্পতি তৈরি করা হয়েছে এবং সেই কাল্পনিক দম্পতির শিশুদের ভুয়া জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করা হয়েছে। রোমানের ঠিকানায় শুধু গ্রামের নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

১১ নভেম্বর বেলা দেড়টায় রোমানের বাড়িতে যখন আমরা পৌঁছাই, তখন তাঁর মা খাদিজা বেগম দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন। কিছুদিন আগে গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, হামলা ও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনায় তাঁদের দোষী করা হবে কি না, সেই আতঙ্কে তিনি আমাদের দেখে ভীত হয়ে পড়েন।

অবশ্য পরিচয় দিয়ে কথা বলে জানা গেল, তাঁর স্বামী গোলাপ মিয়া কুমিল্লায় বেকারির ব্যবসা করেন। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। রোমান দ্বিতীয়। বড় ছেলে রুবেল সৌদিপ্রবাসী। আর রোমান ঢাকায় দোকানে কাজ করেন। মেয়ে বিয়ে করেছেন। তাঁর দুই ছেলের কেউ বিয়ে করেননি।

অর্থাৎ রোমানের স্ত্রী হিসেবে যে মৌসুমির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি ভুয়া। তাঁর ছেলের জন্মনিবন্ধন করেছেন ইউপি কার্যালয়ে। ছেলের জন্মনিবন্ধন ব্যবহার করে ভুয়া আরও নিবন্ধন তৈরির বিষয়টি তাঁদের জানা নেই। কেন ‘শিশুদের বাবা’ হিসেবে রোমানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিও একটু বলা প্রয়োজন। ২০১৩ সালের পর জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন লাগে। ফলে একটি ভুয়া শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে হলে বাস্তবে রয়েছে এমন কারও সনদের তথ্য প্রয়োজন হয়। ইউপি কার্যালয়ে সংরক্ষিত জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের ডেটাবেজে থাকা ব্যক্তিদের প্রকৃত তথ্য ব্যবহার করে এভাবে একাধিক ভুয়া নিবন্ধন তৈরি করা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সাদেকপুর ও বুধল, কসবা উপজেলার কুটি এবং আশুগঞ্জ উপজেলার চরচারতলা ইউনিয়ন ঘুরে ভুয়া নিবন্ধনের তথ্য পাওয়া গেছে। শিশুদের ক্ষেত্রেই ভুয়া সনদের ঘটনা বেশি। এমন অনেক শিশুর নিবন্ধন করা হয়েছে, যারা আসলে জন্মই নেয়নি। কাগজে-কলমে তাদের জন্ম ও মৃত্যু দেখানো হয়েছে। শিশুদের বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ, জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করতে কোনো টাকা লাগে না। এরপর টাকা লাগে (৫ বছর পর্যন্ত ২৫ টাকা)। শিশুর জন্ম দেখিয়ে ৪৫ দিনের মধ্যেই তার মৃত্যু দেখিয়েছেন নিবন্ধকেরা, এতে ভুয়া নিবন্ধনের জন্য তাঁদের পকেটের টাকা খরচ করতে হয়নি। ইউপি সচিবেরা প্রথম আলোর কাছে বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। বলেছেন, শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়, সারা দেশেই জালিয়াতির ঘটনা কম-বেশি ঘটছে।

২০১৩ সালের পর জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন লাগে। ফলে একটি ভুয়া শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে হলে বাস্তবে রয়েছে এমন কারও সনদের তথ্য প্রয়োজন হয়। ইউপি কার্যালয়ে সংরক্ষিত জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের ডেটাবেজে থাকা ব্যক্তিদের প্রকৃত তথ্য ব্যবহার করে এভাবে একাধিক ভুয়া নিবন্ধন তৈরি করা হয়েছে।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জালিয়াতির অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি জেলা হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ, ৭-৮ মাস আগেও জেলাটি জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের দিক দিয়ে ৫৬ নম্বরে ছিল। এ বছরের অক্টোবর মাসে জেলাটি ৫০ ধাপ এগিয়ে ৫ নম্বরে চলে এসেছে। দায়িত্বশীল সূত্রের সহযোগিতায় দীর্ঘ সময় ধরে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সিস্টেম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিনটি উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ২৫৮টি জন্মনিবন্ধন, ২৫১টি মৃত্যুনিবন্ধনসহ মোট ৫০৯টি তথ্য সংগ্রহ করে প্রথম আলো। ভুয়া নিবন্ধন বোঝার উপায় সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক। সেসব নিবন্ধন ধরে গত ১০ থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫টি ইউনিয়ন ঘুরে তথ্য যাচাই করা হয়েছে। ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টিতেই ভয়াবহ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ভুয়া নাম ঢোকানোর ফলে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্যভান্ডার ও সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভুয়া নাম ঢুকে যাওয়ার মানে হচ্ছে ‘সিস্টেম’ দূষিত হওয়া, বাড়তি জনসংখ্যার তথ্য ঢুকে সরকারের পরিকল্পনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। তিনি বলেন, ভুয়া নাম ও তথ্য ঢোকানোর সুযোগ থাকলে রোহিঙ্গাদের নামও ঢুকতে পারে। অপরাধীরা ভুয়া নিবন্ধনগুলো ব্যবহার করার সুযোগ নিতে পারে।

তবে মো. নজরুল ইসলাম নাগরিকদের সচেতন থাকার বিষয়েও জোর দেন। তিনি বলেন, জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হলেও তা কার্যকরে আইনের প্রয়োগ নেই। স্কুলে ভর্তির আগে শিশুদের জন্মনিবন্ধন আর সম্পদ ভাগাভাগির প্রয়োজন ছাড়া নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে মৃত্যুনিবন্ধন করতে দেখা যায় না।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কেন জরুরি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া, পাসপোর্ট নেওয়া ইত্যাদি ১৯টি ক্ষেত্রে জন্মসনদ প্রয়োজন হয়। উত্তরাধিকার ও সরকারি ভাতাসহ বিভিন্ন অধিকার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন মৃত্যুনিবন্ধন। মৃত্যুনিবন্ধন করতে লাগে জন্মসনদ।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪-এর ৮ ধারা অনুসারে, জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধকের কাছে মা-বাবা, অভিভাবক বা নির্ধারিত ব্যক্তি তথ্য দিতে বাধ্য থাকবেন। তবে প্রয়োজন ছাড়া জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করতে আগ্রহ দেখা যায় না পরিবারগুলোর মধ্যে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ১৬ নম্বর অভীষ্টে জন্মনিবন্ধনসহ সবার জন্য বৈধ পরিচয়পত্র দেওয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতিসংঘের আঞ্চলিক সংস্থা ইউএনএসকাপ ঘোষিত ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (সিআরভিএস) দশকের’ আওতায় বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে জন্মের এক বছরের মধ্যে শতভাগ জন্ম ও ৮০ ভাগ মৃত্যুনিবন্ধন নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইউএনএসকাপের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে জন্মের এক বছরের মধ্যে নিবন্ধনের হার মাত্র ৫০ শতাংশ এবং মৃত্যুনিবন্ধনের হার ৪৭ শতাংশ।

বেল পরী, পানি পরী, মুকেশ আম্বানিদের নাম

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সাদেকপুর ইউপিতে গিয়ে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এবং নভেম্বরের প্রথম ১১ দিনের মৃত্যুনিবন্ধনের তালিকা পর্যবেক্ষণ করে অন্তত ৫১টি ভুয়া নাম পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ শিশু মৃত্যুর কারণ দেখানো হয়েছে ‘কার্ডিওজেনিক শক’। কারও কারও ক্ষেত্রে ‘আনঅ্যাটেনডেড ডেথ’, ‘ব্রট ডেড’ লেখা হয়েছে। তালিকায় থাকা নামের মধ্যে ছিল বেল পরী, পানি পরী, পায়েল পরী, মোহাম্মদ মুকেশ আম্বানি, সাদা মানিক, ডিবজল খান। এরাও ১৪ থেকে ২০ নম্বর সন্তান এবং জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে মারা গেছে।

সাদেকপুরে অক্টোবর মাসে ৬১ জনের মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যেই নিবন্ধন হয়েছে ৫৪ জনের। এই ৫৪ জনের মধ্যে অন্তত ৩৩টি নাম ভুয়া বলে নিশ্চিত করা গেছে। মৃত্যুনিবন্ধন করার আগে কোনো শিশু বা ব্যক্তির জন্মনিবন্ধনও করতে হয়। ফলে জন্মনিবন্ধন তালিকাতেও তারা ভুয়া হিসেবে ছিল।

সাদেকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে ভুয়া নাম ঢোকানো হয় না। কিছু ভুলত্রুটি হয়ে যায়।’ টার্গেটের কোনো চাপ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

যমজ জন্ম, যমজ মৃত্যু

কসবা উপজেলার কুটি ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা যায়, একই হোল্ডিং ট্যাক্স, একই রসিদ, একই টিকা কার্ড দিয়ে একাধিক শিশুর জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করা হয়েছে। বেশির ভাগ নিবন্ধনে সংযুক্তি হিসেবে প্রকৃত কোনো কাগজপত্র নেই। অল্প কিছু ক্ষেত্রে মুঠোফোন নম্বর ও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘যমজ জন্ম’, ‘যমজ মৃত্যু’র উদাহরণ ভূরি ভূরি।

জসিমউদ্দিন নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে ২২ অক্টোবর। তাঁর বাবা মৃত রাফিজউদ্দিন ও মা মৃত সাহিদা খাতুন। আবেদন অনুসারে জসিমউদ্দিনের জন্ম ১৯৭৬ সালে। সড়ক দুর্ঘটনায় ২০০৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। জসিমউদ্দিনের জন্মনিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে তাঁর ৪ ও ৫ নম্বর সন্তান হিসেবে এ বছরের ১২ অক্টোবর ‘জন্ম নেওয়া’ আইশা ও মাইশা নামে দুটি শিশুর জন্মনিবন্ধন দেখানো হয়েছে। নিবন্ধনে একটি ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।

ওই নম্বরে ফোন করলে কুটি গ্রামের আমেনা নামের একজন কথা বলেন। তিনি জানান, তাঁর বৃদ্ধ শাশুড়ি হোসনে আরার ফোন নম্বর এটি। গ্রামে আইশা-মাইশা নামে কোনো যমজ সন্তান জন্ম নেওয়ার কথা তিনি শোনেননি। ‘জসিমউদ্দিন-রোকসানা’ নামে কোনো দম্পতিকেও চেনেন না।

৪৫ দিনের মধ্যে বিনা মূল্যে নিবন্ধন করা গেলেও কুটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের একটি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে জন্ম ও মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেও নিবন্ধন বিনা মূল্যে করা যায়। সেই সুযোগে ভুয়া নিবন্ধন করা হয়েছে ৪৫ দিনের বেশি বয়সী শিশুদেরও।

যেমন আক্তার হোসেন ও রুবি আক্তারের ৫ নম্বর সন্তান ১৮ মে ও ৬ নম্বর সন্তান ১৫ আগস্ট জন্ম নেয়। তিন মাসের ব্যবধানে জন্ম নেওয়া ‘প্রায় যমজ’ এই দুটি শিশুর মৃত্যু হয় ৯ সেপ্টেম্বর।

কুটিতে শুধু অক্টোবরে ৩ থেকে ২০ দিন বয়সী ১২ ‘যমজ শিশুর’ অর্থাৎ ২৪টি শিশুর মৃত্যুর তথ্যের উল্লেখ পেয়েছে প্রথম আলো। কেউ ৩ নম্বর, কেউ ৭ নম্বর সন্তান।

কুটি ইউনিয়নে অক্টোবর মাসে ১২০টি জন্ম ও ৪০টি মৃত্যুনিবন্ধন করা হয়েছে। মাসের লক্ষ্য ছিল কমপক্ষে ১০৮টি জন্মনিবন্ধন ও ৩০টি মৃত্যুনিবন্ধন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সাফল্যের হার যথাক্রমে ১১১ ও ১৩১ শতাংশ।

কুটিতে প্রথম আলো সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের ৭০টি মৃত্যু ও ১৪টি জন্মনিবন্ধন যাচাই করেছে। এর মধ্যে ৪০টি মৃত্যুর উল্লেখ পাওয়া গেছে নবজাতকের (২৮ দিন পর্যন্ত বয়স)। শুধু অক্টোবর মাসে ১২টি নবজাতকের মৃত্যুনিবন্ধন পাওয়া গেছে। ওই ইউনিয়নে এত সংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে কি না, তা যাচাই করতে গিয়ে জানা গেছে, বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসেও এত নবজাতকের মৃত্যু হয়নি।

এদিকে এত বেশিসংখ্যক ভুয়া মৃত্যুনিবন্ধন হলেও তা অস্বীকার করেছেন কুটি ইউপি সচিব কাজী তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যতগুলো মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে, সবগুলো মারা গেছে।’

অবশ্য কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান ভুইয়া প্রথম আলোকে জানান, উপজেলাজুড়ে অক্টোবর মাসে কোনো নবজাতকের মৃত্যু হয়নি। হাসপাতাল বা বাসায় যেখানে জন্ম বা মৃত্যু হোক, সেটা রেকর্ড রাখেন তাঁরা।

দম্পতি নিয়ে গোলকধাঁধা

চরচারতলায় মোছা. লাবণ্য আক্তারকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন তথ্যে মো. শিপনের স্ত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই দম্পতির ৩ নম্বর সন্তান তাসনিম সরকারের (৯ দিন বয়সী) মৃত্যুনিবন্ধন দেখানো হয়েছে ২৯ অক্টোবর। জন্মনিবন্ধন নম্বর দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে, একই লাবণ্য আক্তারকে কবির মিয়া নামে এক ব্যক্তির স্ত্রী হিসেবে দেখিয়ে ৩০ অক্টোবর ৪ নম্বর সন্তানের (২০ দিন বয়সী) জন্মনিবন্ধন দেখানো হয়েছে। একই কবির মিয়ার স্ত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে মাকসুদা বেগম নামের আরেক নারী। কবির-মাকসুদা দম্পতির ৩ নম্বর সন্তানের (৮ দিন বয়সী) নিবন্ধন দেখানো হয়েছে ২ নভেম্বর।

মীম নামে এক নারীকে একবার মো. নয়ন ও আরেকবার আজাদ সরকার নামে দুই ব্যক্তির স্ত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে। নয়ন-মীমের ৩ নম্বর সন্তান উম্মে জীণীর জন্ম দেখানো হয়েছে ১০ অক্টোবর। আবার আজাদ-মীমের আরেকটি ৩ নম্বর সন্তানের জন্ম দেখানো হয়েছে ১৩ অক্টোবর।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে চরচারতলা ইউপি সচিব রাসেল মাহমুদ বলেন, ‘শুনেছি, আপনি অনেক জায়গায় খোঁজ করেছেন। আপনি তো বুঝতেই পারছেন বিষয়টা।’ তিনি জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিশুদের টিকা দিতে যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে, তার প্রায় দ্বিগুণ লক্ষ্যমাত্রা তাঁর এলাকায় জন্মনিবন্ধনের জন্য।

‘মৃত’ শিশুর খোঁজে

বিগত ১৫, ১৬ ও ১৮ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নে মৃত্যুনিবন্ধন ধরে শিশুদের খোঁজ করা হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ইউনিয়নের জঙ্গলীসারের সিরাজনগর গ্রামের মোহাম্মদ হেলালের বাড়ির ঠিকানা পাওয়া যায়। চারপাশে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া পাকা ভবনের বাড়ির নিচতলায় হেলালের পরিবার বসবাস করে। বাড়িতে হেলালকে পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। এই দম্পতির ৪ নম্বর সন্তান মো. শিহাব ৩ দিন বয়সে ২ সেপ্টেম্বর মারা গেছে বলে তথ্য রয়েছে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের ডেটাবেজে।

নাজমা তাঁর নিজের ও স্বামীর জন্মসনদ প্রথম আলোকে দেখান। তিনি জানান, তাঁদের ৯, ৫ ও ৩ বছর বয়সী তিন সন্তান রয়েছে। শিহাব নামে তাঁদের কোনো সন্তান নেই। তাঁদের কোনো সন্তানের মৃত্যু হয়নি।

মতিন ও সালমা আক্তার দম্পতির জন্মনিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে তাঁদের ৪ নম্বর সন্তান হিসেবে রিপন আহমেদ নামের এক শিশুর তথ্য ছিল ডেটাবেজে। ১৭ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া শিশুটির মৃত্যু দেখানো হয় চার দিন পর। সালমা আক্তার বলেন, ‘আমার তিন সন্তান। রিপন আহমেদ নামে আমার কোনো সন্তান নেই এবং আমার কোনো সন্তান মারা যায়নি। কয়েক দিন আগে ইউপি কার্যালয় থেকে একটি মৃত্যুসনদ নিয়ে একজন বাড়িতে এসেছিল। বলেছিল এটি রাখতে; কিন্তু আমি রাখিনি। কারণ, আমার কোনো সন্তান তো মারা যায়নি।’

জানা গেছে, ভুয়া মৃত্যুনিবন্ধনের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে, এমনটা জানতে পেরে মতিন ও সালমার বাড়িতে একটি মৃত্যুসনদ দিয়ে এসেছিল বুধল ইউপি কার্যালয়ের লোকজন।

জানতে চাইলে বুধলের ইউপি সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হাসান ভূইয়া বলেন, ‘টার্গেটের চাপ আছে। টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে একটু এদিক-সেদিক করা লাগে।’

‘টার্গেটের চাপ’ কেন

জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের কাজটি কেন্দ্রীয়ভাবে দেখাশোনা করে সরকারি সংস্থা রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন। তবে স্থানীয়ভাবে কাজটি করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো। ইউনিয়ন পর্যায়ে নিবন্ধন করা হয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে। ইউপি সচিব নাম নিবন্ধনের পর ইউপি চেয়ারম্যান তা অনুমোদন করে সনদ দেন। দীর্ঘদিন ধরে জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের মানুষের ভোগান্তি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এসেছে। এবার সামনে এল নিবন্ধনে জালিয়াতির তথ্য।

এই প্রতিবেদন তৈরির কাজের সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক (ডিডিএলজি) ছিলেন শংকর কুমার বিশ্বাস। তিনি বদলি হয়েছেন। তবে ২৭ নভেম্বর প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘টার্গেট পূরণে চাপ প্রয়োগের বিষয়টি সত্য। আমাকে ওপর থেকে চাপ দেওয়া হয়েছে। আমি ইউএনওকে চাপ দিয়েছি। আর ইউপি সচিবদের ওপর ইউএনও “রোলার কোস্টার” চালিয়েছেন।’

লক্ষ্য পূরণ করতে পারলে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হিসেবে জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবসে পুরস্কৃতও করা হয়েছে (এ বছর দেওয়া হয়নি)। না পারলে ইউপি সচিবদের তিরস্কার করা হয়, অদক্ষ বলা হয় ও বদলির হুমকি দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল (২৪ ডিসেম্বর বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন) মো. যাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপের ওপর ভিত্তি করে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বিবিএসের হিসাবে, বছরে ৩২ লাখ শিশু জন্ম নেয়। বছরে আসলে কত শিশু জন্ম নিচ্ছে, এটা স্বাস্থ্য বিভাগ বলতে পারবে। লক্ষ্য হওয়া উচিত কত জন্ম হচ্ছে, সেটার প্রকৃত সংখ্যার ওপর। জালিয়াতির দায় কার, নজরদারি হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি জনবলের ঘাটতির কথা তুলে ধরেন এবং বলেন, ‘জালিয়াতির সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে আমাকে দিন। আমি ব্যবস্থা নেব।’

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য বছরে প্রতি ইউপিতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। এই বিপুল খরচের পর যে তথ্যভান্ডার তৈরি হচ্ছে, সেখানে ১৮ বছর বয়সীকে দেখানো হচ্ছে ১৯ সন্তানের মা, ভূরি ভূরি ভুয়া শিশু জন্ম ও মৃত্যুর তথ্য তো রয়েছেই। তথ্যভান্ডারে থাকা ব্যক্তির তথ্যের কোনো নিরাপত্তা থাকছে না। এসব ভুয়া নিবন্ধনের কারণে পুরো তথ্যভান্ডার হয়ে পড়েছে প্রশ্নবিদ্ধ।