Thank you for trying Sticky AMP!!

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি: শেখ আব্দুল হাইকেই দায়ী করছেন পরিচালকেরা

বেসিক ব্যাংকের ঋণপ্রস্তাব কিংবা ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে বোর্ড সভায় আলোচনা কম হতো। বোর্ড সভার আগের দিন রাতে কিংবা বোর্ড সভার দিন কার্যবিবরণী পরিচালকদের কাছে জমা দেওয়া হতো। আবার ঋণ অনুমোদনের পর সেসব কাগজপত্রের তথ্য পরিচালকদের দেওয়া হতো না। ব্যাংকটির পরিচালকেরা দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) কাছে এমনটাই দাবি করেছেন।

তাঁরা বলেছেন, বছরের পর বছর তাঁদের কিছুই জানতে না দিয়ে একক কর্তৃত্ববলে নামসর্বস্ব কোম্পানির ঋণ অনুমোদন করেন বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলাম।

জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকটির ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

তবে ব্যাংকটির সাবেক পরিচালকদের এমন বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যাংক ও কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞরা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহসানুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের বোর্ড সভার সাত দিন আগে পরিচালকদের কাছে কার্যবিবরণীর সব তথ্য পাঠাতে হয়। ঋণপ্রস্তাব কিংবা অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে। ঋণপ্রস্তাবের কোনো বিষয়ে যদি কোনো পরিচালকের আপত্তি না থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, সর্বসম্মতিক্রমে ঋণ অনুমোদন হয়েছে বোর্ড সভায়।’

আইনজীবী আহসানুল করিম আরও বলেন, ‘আইন মোতাবেক, রেজল্যুশনে পরিচালকদের স্বাক্ষর করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পরিচালকেরা কোনোভাবে বলতে পারেন না; বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির বিষয় তাঁরা কিছুই জানেন না কিংবা জানতে দেওয়া হয়নি। সবকিছু করেছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি। বাস্তবিক অর্থে, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না পরিচালকরা।’

ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৫৯টি মামলা করে দুদক। এসব মামলার কোনোটিতেই শেখ আবদুল হাই আসামি ছিলেন না। তবে অভিযোগ ছিল, বেসিক ব্যাংকের মতো ভালো মানের একটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংককে কেলেঙ্কারিময় ব্যাংকে পরিণত করার হোতা ছিলেন শেখ আবদুল হাই।

তবে সাত বছর নিবিড় তদন্তের পর গত জুনে ৫৯ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় দুদক। এর মধ্যে ৫৮টিতে নাম আছে শেখ আবদুল হাইয়ের। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামির তালিকায় আছেন ৪৬ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ১০১ গ্রাহক। এসব মামলার কোনোটিতে পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করেনি দুদক।

দুদকের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় যাঁদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে দুদক, তাঁদের অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় আদালত যদি মনে করেন, মামলার কোনো সাক্ষী ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাহলে আদালত সাক্ষী থেকে কোনো ব্যক্তিকে আসামি করতে পারেন। আবার মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দিতে পারেন আদালত।

‘দায় এড়াতে না জানার অজুহাত দেখিয়েছেন’

বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ৫৯টি মামলার অভিযোগপত্রের মধ্যে ৫টি মামলার অভিযোগপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ছয়জন পরিচালককে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে। তাতে সবাই দাবি করেছেন, ঋণ জালিয়াতির তথ্য তাঁরা জানতেন না। আদালতে জমা দেওয়া এসব পরিচালকের জবানবন্দির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ পরিচালক প্রায় একই রকমের বক্তব্য দিয়েছেন।

Also Read: ৫৮ মামলায় আসামী বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা শেখ আবদুল হাই

২০১০ থেকে ২০১৪ সাল মেয়াদে বেসিক ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন বাণিজ্যসচিব শুভাশীষ বসু। আদালতে জমা দেওয়া দুদকের নথিতে বলা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে শুভাশীষ বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি দায়িত্ব পালনের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ব্যাংকের সবকিছু দেখা সম্ভব হয়নি। আমার মতে, ব্যাংকের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বোর্ডের দায়দায়িত্ব আছে। কিন্তু মিটিংয়ের রেজল্যুশন সম্পর্কে জানতে দেওয়া হতো না। বোর্ড সভার আগের দিন রাতে ওয়ার্কিং পেপার দেওয়া হতো। ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটির নেতিবাচক মন্তব্যের পরেও কীভাবে ঋণ অনুমোদতি হয়েছে, তা জানি না।’

দুদককে দেওয়া এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব শুভাশীষ বসু প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ জালিয়াতির কোনো তথ্য আমি জানতাম না। সব জানতেন চেয়ারম্যান, এমডি। তাঁরা স্বাক্ষর করেছেন। কাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, আমি যদি কোনো কিছু না জানি, কোনো কিছুতে স্বাক্ষর না করি, তাহলে আমার দায় কোথায়?’

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের অধ্যাপক কাজী আক্তার হোসেন তিন বছর বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, ‘বোর্ড মিটিংয়ের আগের দিন বা সকালে কার্যবিবরণী দেওয়া হতো। এত অল্প সময়ে মিটিংয়ের সব বিষয়বস্তু পড়া সম্ভব হতো না। আর রেজল্যুশনের কপি না দেওয়ায় কোন ঋণপ্রস্তাব পাস হয়েছে, সেটি আমার পক্ষে জানা সম্ভব হতো না।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যাপক কাজী আক্তার হাসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দায় যদি হয়, তাহলে পুরো বোর্ডের হতে পারে। এমন কোনো জালিয়াতি হয়েছে, তখন আমরা তো ধরতে পারিনি। আমরা তো ঘটনা জানতাম না।’

বেসিক ব্যাংকের আরেক পরিচালক ছিলেন যুবলীগের সাবেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, ‘বেসিক ব্যাংকের বোর্ড সদস্যদের রেজল্যুশনে কোনো স্বাক্ষর নেই। এমনকি রেজল্যুশন পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করা হতো না। রেজল্যুশনের বিষয় কথা বললে ব্যাংকের এমডি জানাতেন, বোর্ডের রেজল্যুশনের কপি পরের সভায় দেওয়া হবে। তবে কোনো সভার রেজল্যুশনের কপি আমি পাইনি।’

ঋণ জালিয়াতি নিয়ে আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জালিয়াতির ঘটনা আমরা জানতাম না। আমার যদি কোনো কিছু জানার সুযোগ না থাকে, তাহলে আমার দায় কিসের? ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং এমডি সাহেব সবকিছু জানতেন। নামমাত্র কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে বোর্ডে আলোচনা হতো না।’

Also Read: বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি: ঘুষের টাকায় বাড়ি কেনেন বাচ্চু ও তাঁর ভাই

বেসিক ব্যাংকের পরিচালকদের এমন বক্তব্যকে ‘দায় এড়ানোর অজুহাত’ বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ অনুমোদিত হয় বোর্ড সভায়। তাই পরিচালকদের বলার সুযোগ নেই, তাঁরা ঋণ অনুমোদনের কোনো তথ্য জানতেন না। প্রতিবছরই ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন হয়। সেখানে মন্দ ঋণের তথ্য উল্লেখ থাকে। বছরের পর বছর পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পর কেউ যদি বলে থাকেন, তাঁরা কিছুই জানতেন না, সেটি একেবার ঠিক নয়। ঋণ জালিয়াতির তথ্য জানার পরও কেবল দায় এড়াতে না জানার অজুহাত দেখিয়েছেন পরিচালকেরা।’