আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায়
আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায়

ঢাকা, সিটি ও আইডিয়াল কলেজ শিক্ষার্থীদের দ্বন্দ্বের শুরু কবে, নেপথ্যে কী

ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা তিন বছরে ৯ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। কারও শাস্তি হয় না।

ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজ—রাজধানীর এই তিন কলেজের অবস্থান এক কিলোমিটারের মধ্যে। তবু তাদের মধ্যে দূরত্ব যেন যোজন যোজন।

বহু বছর ধরে কলেজ তিনটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। অতীতে কটূক্তি করা, মারামারি, ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সংঘর্ষ হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি তা জনদুর্ভোগের কারণ হচ্ছে।

সর্বশেষ গত রোববার ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। ঘটনাটিতে প্রায় তিন ঘণ্টা রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব ও গ্রিন রোড এলাকায় যান চলাচল বন্ধ ছিল।

প্রশ্রয় ছাড়া এভাবে সংঘর্ষে জড়ানো সম্ভব নয়। যারা জড়ায়, তারা জানে, তাদের কিছুই হবে না।
মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও ঢাকা কলেজের প্রাক্তন ছাত্র

তিন কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন বছরে কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের ৯টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কোনো ঘটনায় সংঘর্ষে জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির পাওয়া যায়নি। আশকারা পেয়েই তাঁরা সংঘর্ষে বারবার জড়ান।

ডিএমপির রমনা বিভাগের নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহেন শাহ মাহমুদ বলেন, তিন কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা তুচ্ছ কারণে ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছেন। পুলিশ আছে মহাবিপদে। তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনা প্রতিরোধে আইনগত যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা আমরা নিই। কিন্তু আমরা শতভাগ হার্ড লাইনে যেতে পারি না। শিক্ষার্থীদের বয়সের একটা ব্যাপার আছে এবং এগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়।’

শুরু কখন, উৎস কী

ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪১ সালে। ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক-স্নাতকোত্তর মিলিয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি৷ এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।

ঢাকা সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজ বেসরকারি। সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে। তখন এর নাম ছিল ঢাকা নাইট কলেজ। একসময় ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসেই কলেজের কার্যক্রম চলত। ১৯৭০ সালে ঢাকা সিটি কলেজ নামে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা হয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজারের বেশি। আইডিয়াল কলেজ ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতকে প্রায় চার হাজার ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করেন।

তিন কলেজের দ্বন্দ্বের শুরুটা কোথায়, তা কেউ জানাতে পারেননি। তবে একাধিক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে মারামারিতে জিততে হবে। নতুন শিক্ষার্থীরা পুরোনোদের কাছ থেকে এই শিক্ষা পেয়ে আসছেন।

এখন তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের উসকে দেওয়া হয়। শিক্ষকেরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের ভেতরে দুটি বিষয় কাজ করে—একটি কলেজ ‘ন্যাশনালিজমের’ (জাতীয়তাবাদ) নামে উগ্রতা, অন্যটি এথনোসেন্ট্রিসিজম (নিজেরটি সেরা ভাবার প্রবণতা)।

সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষ হয়। সেদিনের সংঘর্ষের শুরুটাও ‘সাহস দেখানোর’ মধ্য দিয়ে। ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহর সেদিনের ভাষ্য অনুযায়ী, সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা আইডিয়াল কলেজের ফটকে গিয়ে ‘তোরা মুরগি, সাহস থাকলে বের হ’ বলে চিৎকার করেন। এরপরই দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি বেধে যায়।

সর্বশেষ সংঘর্ষের আগে ফেসবুকে বাগবিতণ্ডা, শিক্ষার্থীদের বাসে ঢিল ছোড়া, আরেক কলেজের ফটকের সাইনবোর্ড খোলা—এসব ঘটনার মধ্যে ‘কলেজ ন্যাশনালিজমের’ নামে উগ্রতার উপাদানগুলো দেখা যায় বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ঢাকা কলেজে দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেছেন আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার। তিনি কলেজটির অধ্যক্ষও ছিলেন। তিনি বলেন, দ্বন্দ্বের শুরু ২০০০ সালের পর থেকে। তখন ছোটখাটো মারামারির ঘটনা শোনা যেত। তবে তা কখনোই বড় পর্যায়ে যায়নি। কয়েক বছর ধরে বড় ঘটনা ঘটছে।

শাস্তি নেই

তিন কলেজের শিক্ষার্থীরা বারবার সংঘর্ষে জড়ালেও পুলিশ যেমন তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয় না, তেমনি কলেজ কর্তৃপক্ষও নীরব থাকে।

অবশ্য ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইউসুফ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সংঘর্ষের ঘটনাগুলোয় তাঁরা ব্যবস্থা নেন। তিনি বলেন, ‘সব ঘটনাতেই আমাদের শিক্ষকেরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করে নিয়ে আসেন। কিন্তু আমরা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য পক্ষগুলোর (সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজ) আন্তরিকতার অভাব লক্ষ করি।’

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, সংঘর্ষের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ক্যাম্পাসের বাইরে ঘটে। এসব ক্ষেত্রে সঠিক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না।

আন্তরিকতার অভাব নিয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দাবি সত্য নয় বলে মন্তব্য করেন আইডিয়াল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনিরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে আমরা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট বা বদলি সনদ) দিয়ে কলেজ থেকে বের করে দিয়েছি।’

আইডিয়াল কলেজের একাধিক শিক্ষক বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজনকে কলেজ থেকে টিসি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংঘর্ষের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা কখনোই নেওয়া হয়নি।

‘প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে’

তিন কলেজে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় মূলত একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। তাদের বেশির ভাগের বয়স থাকে ১৮ বছরের নিচে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুরুতেই তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক হবে না। তাদের প্রথমে সতর্ক করতে হবে। বারবার ঘটনা ঘটালে কলেজ কর্তৃপক্ষকে জড়িত শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এরপরও না থামলে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্রয় ছাড়া এভাবে সংঘর্ষে জড়ানো সম্ভব নয়। যারা জড়ায়, তারা জানে তাদের কিছুই হবে না। তিনি বলেন, এসব বন্ধ করতে হলে আগে প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

সংশোধনী: আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোর তৃতীয় পৃষ্ঠায় 'আশকারা পেয়ে বারবার সংঘর্ষে শিক্ষার্থীরা' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি অংশে ভুলক্রমে লেখা হয়েছে যে ঢাকা কলেজের 'উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক-স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীসংখ্যা আড়াই হাজারের মতো'৷ প্রকৃতপক্ষে ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক-স্নাতকোত্তর মিলিয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি৷ শুধু উচ্চমাধ্যমিকে শিক্ষার্থীসংখ্যা আড়াই হাজারের মতো৷ অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি৷