আধুনিক স্থাপত্যকলার এই বাড়িতে আছে প্রকৃতির ছোঁয়া
আধুনিক স্থাপত্যকলার এই বাড়িতে আছে প্রকৃতির ছোঁয়া

কাকলী ম্যানর

যেন প্রশান্তির এক বাড়ি

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সারি ধরে বহুতল আবাসিক ভবন। এর মাঝে একটি কর্নার প্লটজুড়ে রয়েছে সবুজে ঘেরা তিনতলা একটি বাসা। সামনে প্রশস্ত সুইমিংপুল, ফেয়ার-ফেস কংক্রিটে তৈরি করা ভবনটি যে কারও মন কেড়ে নেয়। শহরের ব্যস্ততম আবাসিক এলাকায় এক টুকরা প্রশান্তির ভবনটির নাম ‘কাকলী ম্যানর’। স্থপতি ফয়সাল আহমেদের তৈরি করা ভবনটি যেমন সমাদৃত হয়েছে দেশে, তেমনই এনেছে আন্তর্জাতিক সম্মান।

কাকলী ম্যানরের মূল আকর্ষণ ছিল এর অন্তর্মুখী ডিজাইন। বাইরে থেকে প্রথম দেখায় মনে হবে সবুজের আচ্ছাদনে এক টুকরা কংক্রিট যেন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যতই সামনে এগোবেন, ততই স্পষ্ট হবে ভবনের সৌন্দর্য, বিশেষ করে কংক্রিটের সৌন্দর্য। ফেয়ার-ফেস কংক্রিটের যে কঠিন ও দৃঢ় রূপ, সেটিকে ভেঙে ভবনটিকে নতুন একটি রূপ দিয়েছেন ফয়সাল আহমেদ। এফ২এ+ পার্টনারসের স্বত্বাধিকারী স্থপতি ফয়সাল আহমেদ জানান ভবন নকশার পেছনের গল্প।

ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘শুরুতে বাড়ির মালিক কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন, বসুন্ধরার মতো এলাকায় বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট করবেন, নাকি ছোট্ট বাসা তৈরি করবেন, এ নিয়ে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের জন্য ছোট্ট ছিমছাম বাসাই পছন্দ হয় তাঁর। শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল ভবনটা তৈরি হবে আমাদের নিজস্ব কলাকৌশলে কিন্তু মানদণ্ডটা থাকবে বৈশ্বিক।’

একক পরিবারের জন্য তৈরি করা হলেও কাকলী ম্যানরে রয়েছে সেই পুরোনো দিনের যৌথ পরিবারের ছায়া। আগেকার দিনে দেখা যেত যৌথ পরিবারের গল্প, যেখানে একটি উঠানকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠত পুরো বাড়ি। মামা-চাচা-খালুদের সঙ্গে কথাবার্তা, আড্ডা সব হতো একই উঠানে। এক উঠান থেকেই বলে ফেলা যেত পুরো বাসার চিত্র। ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘এখনকার যুগে বাসার ভেতরে উঠান তৈরি করা বেশ কষ্টসাধ্য। আমরা উঠানকে তৈরি করেছি বিভিন্ন লেয়ারে। যেহেতু পারিবারিক বাসা, সেহেতু সবার সঙ্গে সবার মেলবন্ধনের ব্যাপারে আলাদা করে লক্ষ্য ছিল। প্রতিটি তলা ধরে ধরে, কীভাবে কার সঙ্গে কার সংযোগ হবে। আমার সবার সঙ্গে যাতে সবার বসার ঘর থেকে একটা ভিজ্যুয়াল কানেকশন থাকে, সেটাই রক্ষা করা হয়েছে। যে কারণে প্রতিটি তলাই হয়েছে একটি থেকে আরেকটি অনেকখানি আলাদা।’

আছে পানির ছোঁয়াও

নকশা করতে গিয়ে প্রকৃতিকে একেবারে ফেলে দেননি ফয়সাল আহমেদ। যতটা সম্ভব প্রকৃতিকে অক্ষত রেখেই কাজ চালানো হয়েছে। ভবনের পূর্ব পাশে রয়েছে সবুজের আচ্ছাদন, বাইরের দিকে থাকা একটি গাছও কাটা হয়নি নির্মাণের সময়েও। যেভাবে ছিল, সেভাবেই সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে ভবনের।

প্রতিটি তলায়, ভবনের বাউন্ডারি দেয়ালজুড়ে রয়েছে সবুজের সমারোহ। সারি সারি বিল্ডিংয়ের ভিড়ে যাতে সবুজটা হারিয়ে না যায়, সেদিকেও খেয়াল ছিল। সারি সারি গাছের কারণে সূর্যের তাপ সরাসরি প্রবেশ করে না ভবনের ভেতরে, ফলে ঠান্ডা আবহ থাকে সারা দিন। শুধু গাছ দিয়ে নয়, সামনের সুইমিংপুলও ঠান্ডা রাখছে ঘরকে। বসার ঘরের ঠিক সামনে উত্তর–পূর্ব দিকে থাকা সুইমিংপুল ঠান্ডা বাতাস নিয়ে আসে বসার ঘরে। চাইলে বসার ঘরের দরজা খুলে দিয়ে পা ভেজাতে পারবেন পুলে, পড়ন্ত বিকেলে কাটতে পারবেন সাঁতারও।

তবে কাকলী ম্যানরের অন্যতম বিশেষ দিক হলো কংক্রিটের স্ট্যাম্পিং। ভবনের বিভিন্ন জায়গায় কংক্রিট খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে চিত্রকর্ম। ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে শৌখিন অনেকেই দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের চিত্রকর্ম ঠাঁই দেন। কিন্তু স্থপতি চেয়েছিলেন সে রকম চিত্রকর্মই থাকবে বিভিন্ন ফলকে, যা শুধু ঘরের ভেতরের সৌন্দর্যই বাড়ায়নি, পুরো ঘরকে করে তুলেছে অনন্য। স্ট্যাম্পিংয়ের কাজ চলাকালীন বিশ্বজুড়ে আঘাত হানে করোনা, ফলে নির্মাণকাজেও কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে তাঁদের।

স্প্যানিশ কোম্পানি পোরসেলেনোসা গ্রুপের আয়োজিত ২০২৩ পোরসেলেনোসা ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্ট অ্যাওয়ার্ড বা পিপা অ্যাওয়ার্ডে সেরা আবাসিক ভবন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে কাকলী ম্যানর। পোরসেলেনোসা মূলত একটি টাইলস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সাল থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন শ্রেণিতে সেরা ভবনকে পুরস্কৃত করে তারা।

২০২৩ সালে সারা বিশ্ব থেকে বাছাই করা ২২টি প্রকল্প থেকে সেরা চারে স্থান পায় ভবনটি। সেরা চারে কাকলী ম্যানরের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল বিশ্বনন্দিত স্থপতি নরমান ফস্টারের ‘চেশায়ার হাউস’। ২০২৩ সালে লন্ডনে জুরিবোর্ডের সামনে নিজের প্রকল্প উপস্থাপন করেন স্থপতি ফয়সাল আহমেদ ও তাঁর সহধর্মিণী স্থপতি সানজিদা আহমেদ। সেখানে অন্যদের পেছনে ফেলে সেরা পুরস্কার জিতে নেয় কাকলী ম্যানর।