
করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফন-কাফন ও সৎকারের কাজ করে আসছে শেখ বোরহান উদ্দিন (রহ.) ইসলামী সোসাইটি (বিআইএস) মৌলভীবাজার নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এক বছর ধরে সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবীরা এ কাজ করে আসছেন। অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে সংগঠনটির সদস্যদের।
করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারের স্বজনেরা যখন লাশের পাশে আসেননি, তখন এই স্বেচ্ছাসেবীরা দাফন-কাফন ও সৎকারের কাজ করছেন। কোথাও দাফন-কাফন বা সৎকারের প্রয়োজন হলে তাঁরা ছুটে গেছেন। এ পর্যন্ত সংগঠনটি ২৬ জনের লাশ দাফন-কাফন ও সৎকারের কাজ সম্পন্ন করেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিআইএস ২০০১ সাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই মাস্ক, স্যানিটাইজার বিতরণসহ সচেতনতামূলক কাজ করছে। সংগঠনের উদ্যোগে আশরাফুল খান রুহেলকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে ৪০ সদস্যের দাফন-কাফন ও সৎকার টিম। এ কাজে যুক্ত হওয়া সহজ ছিল না। পরিবার থেকে অনেককে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। তবু নানা কৌশলে তাঁরা যুক্ত থেকেছেন। আবার কোনো কোনো পরিবার তাঁদের কাজে উৎসাহও জুগিয়েছে। এসব কাজ করতে গিয়ে তাঁরা মানুষের ভেতরের রূপটা দেখেছেন।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম মুহিবুর রহমান মুহিব বলেন, মানুষের মধ্যে যে একটি সামাজিক বন্ধন ছিল, করোনা মহামারিতে সেখানে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। করোনায় মৃত ব্যক্তির কাছে স্বজনেরা পর্যন্ত আসতে চান না। তাঁদের দলটি তখন দাফন-কাফন ও সৎকার করে দিচ্ছে। আবার করোনায় আক্রান্ত রোগীকে ফ্রি অক্সিজেন সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাত–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য সেবা নিশ্চিত করছেন তাঁরা। এসব কাজে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন প্রবাসী, জনপ্রতিনিধি, সংবাদকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সংগঠনটির কয়েক সদস্য বলেন, গত বছরের ৯ আগস্ট করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজনগরের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে রাত ১১টায় দাফন-কাফনের জন্য তাঁদের স্বেচ্ছাসেবী দল ওই গ্রামে পৌঁছায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মৃত ব্যক্তির বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ নিয়ে বসে আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। তাঁরা স্কুলপড়ুয়া এক ছেলেকে আগেই হারিয়েছেন। এবার আরেক ছেলেকে হারিয়ে তাঁরা শোকে পাথর। করোনার ভয়ে প্রতিবেশীদের বাড়ির ফটকে তালা, ঘরের দরজা বন্ধ। কেউ কাছে আসছেন না। এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা লাশ গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরান। পরে রাত দুইটার দিকে বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে মসজিদের পাশে কবর খুঁড়ে তাঁরা লাশের দাফন সম্পন্ন করেন।
এসব কাজে অনেকের কাছ থেকেই পিপিই, মাস্ক ও স্যানিটাইজার পেয়েছেন তাঁরা। কেউ দিয়েছেন পরিবহন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার অর্থ। সহযোগিতা করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ও সিইও শামস উল ইসলাম, সাজ্জাদুর রহমান পুতুল ফাউন্ডেশনের মনোয়ার আহমেদ, প্রাউড টু বি সিলেটি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ইউকে, নাফকো গ্রুপ, মাদারিস মুক্তাদির তরফদার ফাউন্ডেশনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব তানভীর আহমেদ তরফদার, মোহাম্মদ তৈয়ব ও সৈয়দা তাহেরুন্নেছা ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, একাটুনা ইউনিয়ন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মকিস মনসুর, ব্রিটেনপ্রবাসী আবদুল লতিফ, মুরাদ খান ফাউন্ডেশন ও সিলেটি দাতাগোষ্ঠী। আবুল খায়ের গ্রুপ থেকে ছোটবড় ২৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার তাঁদের দেওয়া হয়েছে। তা দিয়ে গত মাসের ১৬ জুন থেকে চালু করা হয়েছে অক্সিজেন ব্যাংক। এর কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
আজ সোমবার মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান বলেন, এই সংগঠনসহ আরও কিছু সংগঠন করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে মাঠেঘাটে কাজ করছে। তারা মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফন করছে। এতে মৃত ব্যক্তির পরিবার উপকৃত হচ্ছে। জেলাবাসী উপকৃত হচ্ছে। এ কাজে সবাইকে সহযোগিতা করা দরকার।