
উপস্থিত পুরুষেরা চলে এলেন অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চে। ডান হাত সামনে তুলে একসঙ্গে বললেন, ‘আজ থেকে আমি আমাদের বাসায় যে কাজগুলো আছে, যে কাজগুলো আমাদের বোনেরা করে, মায়েরা করে, স্ত্রীরা করে—গৃহস্থালির সব কাজ ভাগাভাগি করে সম্পন্ন করব।’
আজ শনিবার সকালে ‘একশনএইড-প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় বিতর্ক উৎসব ২০১৯’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী পর্বে দেখা গেল এমন দৃপ্ত শপথ। একশনএইড ও প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে রাজধানীর সোবহানবাগে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মিলনায়তনে এই উৎসব হচ্ছে। সহযোগিতায় নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উৎসবের স্লোগান, ‘গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন; আনবে সমতা, করবে উন্নয়ন।’
সকাল সোয়া ৯টায় বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা, একশনএইড–এর প্রকল্প সমন্বয়কারী ইসরাত জাহান।
উদ্বোধনের পর হয় আলোচনা পর্ব। এই পর্বে একশনএইড–এর প্রকল্প সমন্বয়কারী ইসরাত জাহান বলেন, কোনো কাজই ছেলে বা মেয়ের জন্য আলাদা নয়। নারীকে দৈনিক সাড়ে সাত ঘণ্টার বেশি ঘরের কাজ করতে হয়। দিনের কাজে মন দিয়ে নারী উন্নয়নমূলক বা আর্থিক কাজে যুক্ত হতে পারে না।
রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে এক জরিপে দেখা গেছে, একজন নারীকে দৈনিক সাড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ করতে হয়, যার কোনো আর্থিক মূল্য সে পায় না।
বন্ধুসভার সভাপতি সাইদুজ্জামান রওশন বলেন, ‘আমি শপথ করতে চাই, আমাদের বোন-মা-স্ত্রী যা করেন, তাঁদের কাজের সঙ্গে নিজের কাজ ভাগ করে নেব। আমি নিজে লজ্জিত। কারণ, গৃহে আমি কাজ করি না। কিন্তু আমাদের সবার গৃহের কাজে সহযোগিতা করা উচিত।’
সাইদুজ্জামান রওশন তাঁর বক্তব্যের পর অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুরুষদের নিয়ে শপথ নেন।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান মো. সবুর খান বলেন, ‘শুধু অর্থ হলেই সমাজে শান্তি আসবে না। শান্তির জন্য দরকার মানসিক সমৃদ্ধি। গৃহে নারীর কাজ সম্পর্কে আমরা সবাই সচেতন। তবে তা তৃণমূলে পৌঁছায় না। তাই বিষয়টি শুধু বিতর্কের মঞ্চের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। নারীর কাজের সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে হবে। পুরুষেরা নারীর কাজের স্বীকৃতি না দিলে কোনো লাভ হবে না।’
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, ‘বিজ্ঞান গৃহস্থালি কাজের রান্না, ঘর মোছা, কাপড় ধোয়াসহ অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তবে মূল সমস্যাটা আসলে পুরুষের মনের মধ্যে। পুরুষতন্ত্র আমাদের মনের মধ্যে জেঁকে বসে আছে। এটা দূর করতে হবে। সংসার একটা যৌথ ব্যাপার। আমরা বলে থাকি, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এটা সত্য নয়। সংসার আসলে সুখের হয় পুরুষ ও রমণীর উভয়ের গুণে। এটা একটা বাইসাইকেলের মতো। এক চাকা নষ্ট হলে আরেক চাকা দিয়ে চালানো যাবে না। নারীরাও সমাজের ও দেশের উন্নয়নে কাজ করবে। একটা চাকা নষ্ট করে আমরা এগোতে পারবে না।’
অনুষ্ঠানে গাইবান্ধার কৃষক মোছাম্মৎ সালমা বেগম বলেন, ‘আমরা বাড়ির কাজ করি সারা দিন। অবসর মেলে না। সকাল থেকে রান্না, ঝাড়ু দেওয়াসহ আমাদের সারা দিনের কাজের মূল্যায়ন করা হয় না।’
একশনএইড–এর কর্মকর্তা নূরে জান্নাত তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, প্রথমে নারীর গৃহস্থালির কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। তারপর গৃহের কাজ পরিবারের সব সদস্যদের মাঝে পুনর্বণ্টন করতে হবে। ফলে নারীর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া কাজের চাপ কমবে। নারী আর্থিক উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত হতে পারবে। পুরো যাত্রায় তরুণদের অংশগ্রহণ করতেই এই বিতর্কের আয়োজন।
বিতর্ক উৎসবের উদ্বোধনী পর্ব উপস্থাপনা করেন ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক কামরুন্নাহার মৌসুমী। ঢাকা অঞ্চলের ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। সারা দিনে বিতর্কের বিষয়বস্তু হচ্ছে—গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ, জিডিপিতে এই কাজের অন্তর্ভুক্তি, সেবার স্বীকৃতি ও পুনর্বণ্টন।