Thank you for trying Sticky AMP!!

বাড়ি থেকে পালানো সেই সুরসম্রাটের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

সুরের নেশায় বাড়ি থেকে পালানো সেই প্রখ্যাত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর আজ ৬ সেপ্টেম্বর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। অথচ এই শিল্পীর স্মরণে তাঁর জন্মস্থানে নেই তেমন কোনো আয়োজন ও কর্মসূচি। ১৮৬২ সালের এপ্রিল মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ‍উপজেলার শিবপুর গ্রামে সংগীত পরিবারে অনন্য এই সুরসাধকের জন্ম। আর ১৯৭২ সালের আজকের দিনে ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের মাইহারে তিনি মারা যান। তাঁর বাবা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁ ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। তাঁর ডাকনাম ছিল আলম।

সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন। এখানে একটি জাদুঘরও আছে

বাহারি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। বড় সরোদসহ বেশ কিছু অসাধারণ বাদ্যযন্ত্র তাঁরই হাতে জন্ম হয়েছে। তাঁরই নির্দেশে ছেলে আলী আকবর খাঁর জন্য এই সরোদ বানিয়েছিলেন ছোট ভাই ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন অনেক রাগরাগিণী। তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি প্রথম উপমহাদেশে রাগসংগীতকে পরিচিত ও প্রচার করেন।

সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র সেতার

শিবপুর গ্রামেই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মা-বাবার কবর। বড় ভাই আফতাব উদ্দিন খাঁর সমাধি ও নিজের হাতে গড়া একটি মসজিদ রয়েছে সেখানে। জেলা শহরে আছে একটি বাড়ি, যা ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন’ নামে পরিচিত। তাঁর এবারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য কোনো আয়োজন নেই। তবে রোববার সন্ধ্যায় সংগীতাঙ্গনের মিলনায়তনে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মারক ছবিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও তাঁর আত্মার মাগফিরাতের জন্য নীরবতা পালন ও শিবপুর গ্রামে দুটি মসজিদে দোয়ার আয়োজন করার কথা রয়েছে।

সুরসাধকের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র সারোদ

শিবপুর গ্রামে বিশ্বখ্যাত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছাড়াও তাঁর ছোট ভাই সুরসাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, বড় ভাই ‘মলয়া’ গানের সুরস্রষ্টা ফকির তাপস আফতাব উদ্দিন খাঁ, প্রখ্যাত সুরকার শেখ সাদী খান, রাজা হোসেন খান, সরোদশিল্পী ওস্তাদ শাহাদাৎ হোসেন খানসহ অনেক সংগীতজ্ঞ জন্মগ্রহণ করেন।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বড় ভাই ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর মেয়ের বংশধর ইদ্রিস খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে সম্মান বড় বাবার (আলাউদ্দিন খাঁ) পাওয়ার কথা, এলাকা থেকে তিনি তা পাচ্ছেন না। এখানে সেভাবে তাঁকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। আর আজ তেমন কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি।’ তিনি বলেন, আলাউদ্দিন খাঁর বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে তাঁর বাবা সবদর হোসেন খাঁ (সদু খাঁ) ও মা সুন্দরী খানমের শতবছরের পুরোনো দুটি কবর আছে। এটি ওস্তাদ পরিবারের সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু এটি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র

তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাদাসিধে ও ভীষণ ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। অর্থের প্রতি কোনো ধরনের লোভ ছিল না তাঁর। অনেক বড় বড় দরবার থেকে (হায়দরাবাদ, কাশ্মীর) মোটা টাকার চাকরির আমন্ত্রণ পেয়েছেন। কিন্তু মাইহারের সামান্য টাকার চাকরি ছেড়ে সেসব জায়গায় যাননি তিনি। সুরের নেশায় ছোটবেলায় স্কুল পালিয়েছেন, বাড়ি ছেড়েছেন দুবার। সুরের টানে গেছেন কলকাতায়। কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের নাচের দলের সঙ্গে ভ্রমণ করেছেন ইউরোপে।

জাদুঘরে প্রর্দশন করা হয়েছে বাদ্যযন্ত্র ও আলোকচিত্র

১৯৫৬ সালে আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাস করার ইচ্ছায় শহরের পুরাতন জেল রোডের বাড়িটি আলাউদ্দিন খাঁ কিনে নেন। সেই বাড়িই এখন ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন’, যেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি জাদুঘর’। ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক বর্তমানে স্বাস্থ্যসচিব মো. আবদুল মান্নান এটি উদ্বোধন করেন। এই সংগীতাঙ্গনে কণ্ঠ, যন্ত্রসংগীত, চিত্রাঙ্কন ও নৃত্যকলা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

সংগীতাঙ্গন সূত্র জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছাত্রলীগ, ব্যবসায়ী ও পুলিশের সঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্রদের সংঘর্ষে মাসুদুর রহমান নামের এক ছাত্রের নিহতের ঘটনায় ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সে সময় জাদুঘরে রাখা আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত দুটি সরোদ, দুটি বেহালা, একটি সন্তুর, একটি ব্যাঞ্জো ও একটি সারেঙ্গি, তাঁর হাতে লেখা অন্তত ২৫টি চিঠি, হজের সময় সৌদি আরবের বাদশাহর দেওয়া জায়নামাজ, ব্রিটিশ শাসনাধীন তৎকালীন ভারতের দেশীয় রাজ্য মাইহারের রাজা বৃজনাথ সিংয়ের দেওয়া রেওয়াজের দুটি গালিচা, তাঁর নিজের একটি বড় ছবি, দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনায়ক, সরকারপ্রধান ও বিশ্ব ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তোলা অন্তত এক হাজার দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র ও আলোকচিত্রের অনুলিপি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, শিবপুরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নিজের হাতে গড়া প্রাচীন একটি মসজিদ, বড় ভাই আফতাব উদ্দিন খাঁর সমাধি, সুরসম্রাটের মা-বাবার কবর, তাঁর পৈতৃক ঐতিহাসিক বাড়িসহ রেখে যাওয়া কোনো স্মৃতিচিহ্নই এখন পর্যন্ত সংরক্ষণে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদের সদস্য শামীম খান প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। প্রতিবছরই তাঁর স্মরণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শিবপুর ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয় জামে মসজিদ ও আলাউদ্দিন খাঁর নিজের হাতে গড়া মসজিদে দোয়া ও তবারক বিতরণ করা হবে।

সারোদের অন্যান্য অংশ

সংগীতাঙ্গনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নাট্যজন ও সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান সরকার জানান, করোনার কারণে এ বছর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। বর্তমানে জাদুঘরে বাজনা, তবলা, সেতারার ভগ্নাবশেষসহ কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি আছে। এখানে কালচারাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সুরশৃঙ্গার, চন্দ্রসারঙ্গ, নলতরঙ্গ, বড় সারঙ্গ, সেতার, ব্যাঞ্জো ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র এবং হেমন্ত, হেম-বেহাগ, মদন-মঞ্জরি, মঝ খাম্বাজ, শুভাবতী, দুর্গেশ্বরী, প্রভাকরী, হেমন্ত-ভৈরব ইত্যাদিসহ নতুন নতুন অনেক রাগরাগিণী আলাউদ্দিন খাঁরই সৃষ্টি। ২০০ রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন এই সুরস্রষ্টা। তবে সুরের এই কিংবদন্তিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।