সবুজ পার্কের সামনে ‘ডাক্তার রফিকের’ বিবর্ণ মুখ

খদ্দেরের আশায় খুলনার শহীদ হাদিস পার্কের ফটকে বসে আছেন ‘ডাক্তার রফিক’।
 ছবি: প্রথম আলো

করোনাকালে খুলনার শহীদ হাদিস পার্কের ফটকগুলো তালাবদ্ধ। অনেক দিন হয়ে গেল ভেতরে মানুষের পা পড়ে না। এই সুযোগে পার্কের খোলা জমিনে বেড়ে উঠেছে সবুজ ঘাস। পাতার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে টুকটুকে লাল রঙ্গন আর অপূর্ব শোভার জারুল। বর্ষায় স্নান করে আরও সবুজ হওয়া কৃষ্ণচূড়ার ডাল যেন পার্কের সীমানায় আটকে থাকতে নারাজ। প্রাচীরের ওপর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে পথে। সেই পথেই প্রাচীরের কোল ঘেঁষেই একটা চেয়ার নিয়ে আনমনা বসে আছেন ‘ডাক্তার রফিক’।

পুরো নাম রফিকুল ইসলাম। বয়সের হিসাব ঠিকঠাক না দিতে পারলেও জানালেন পঞ্চাশের কাছাকাছি। গায়ে ঢিলেঢালা বেশ পুরোনো শার্ট, মুখে কাপড়ের মাস্ক, মাথায় সাদা টুপি আর পরনে লুঙ্গি। গলায় ঝোলানো ছয় ইঞ্চি বাই আট ইঞ্চির বাক্সের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরি করা। তাতে সাজানো চারটি বোতল, সঙ্গে কিছু তুলা আর টুকিটাকি যন্ত্রপাতি। ২০ বছর ধরে এই বাক্স ঘিরেই রফিকের স্বপ্ন ঘুরপাক খেয়েছে। রফিক আর তাঁর পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাক্সের ভেতর থাকা সরঞ্জাম দিয়ে মানুষের কান পরিষ্কার করেন তিনি। মানুষ তাঁদের ‘ডাক্তার’ নামেই ডাকে।

রফিকের চেয়ারের পেছনে একটি বোতলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা। মাঝেমধ্যে তা হাতে ঘষে নিচ্ছেন। আলাপে আলাপে জানা গেল, বছর সাতেক আগে হাদিস পার্ক এখনকার আদল পেয়েছে। এর আগে পুরোনো পার্কে রফিকুলদের ব্যবসাটা ভীষণ জমজমাট ছিল। শহরের অনেক পরিবার কানে কিছু ঢুকলে পার্কে আসতেন। তাঁদের কাজ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আয়ও মন্দ ছিল না। তখন ১০ থেকে ১২ জন এই পার্ক এলাকায় কান পরিষ্কারের কাজ করতেন। এখন পেশায় আছেন দু-তিনজন। করোনার সময়ে তাঁরাও অনিয়মিত। অনেকে কানে মোম, চাল এসব ঢুকলে এখনো পার্কে নিয়ে আসেন, তখন তাঁদের আয়টা একটু বেশি হয়।

রফিকের সঙ্গে কথা বলার সময় রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি টহল দিচ্ছিল। পার্কের সামনে রাস্তা ছিল প্রায় জনমানবহীন। মাঝেমধ্যে দু-একটা রিকশা টুংটাং শব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল। রফিক বললেন, ‘সকাল আটটায় বেরিয়েছি। এখন এই সাড়ে তিনটা পর্যন্ত দুজন খরিদ্দার মিলেছে। সব মিলে আয় আজ ৬০ টাকা। পার্ক খোলা থাকলে খরিদ্দার হয়।’

অন্য সময় দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। পার্ক বছরখানেকের বেশি বন্ধ। তবে পার্ক বন্ধ থাকলেও শহর খোলা থাকলে কিছু কাজ হয়। এখন তো শহরও বন্ধ। কাজ হবে কী! দীর্ঘশ্বাস পড়ে রফিকের।

দীর্ঘ ১০ দিন পর গত শনিবার কাজে বের হন রফিক। লকডাউনে যানবাহন পাওয়া কষ্ট, আবার মিললেও ভাড়া বেশি। তাই প্রায় সাত কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছেন। রফিক বলছিলেন, ১০ দিন বসে খেয়ে বেশ ধারদেনা হয়েছে। অবশেষে আর কোনোমতেই চলছে না, তাই বের হওয়া। বেরিয়ে দেখছেন, শহরের অবস্থা ভালো না। এদিকে ছেলের মাদ্রাসায় পাঁচ মাসের বেতন বাকি পড়েছে। ঘরে অসুস্থ মায়ের উচ্চ রক্তচাপ আর ডায়াবেটিক। ওষুধ কিনতে হয়। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আত্মীয়স্বজন আছে। সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন।

রফিকুলদের পৈতৃক বাড়ি বরিশালের গৌরনদীতে। তাঁর বাবা ছিলেন খুলনার ভৈরবঘাট এলাকার একজন শ্রমিক সরদার। তবে জন্ম খুলনাতেই। এখন থাকেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে কাদেরের খাল এলাকায়।

রফিক জানান, আগে শহরের রেলবস্তিতে থাকতেন। নতুন রেলস্টেশন হওয়ার সময় তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়। তাঁরা ৩০ থেকে ৩৫ পরিবার একসঙ্গে চলে যান ওই এলাকায়। ভাড়া শহরের তুলনায় কম।

করোনাকালে কোনো রকম সহায়তা পাননি রফিক। রফিকের ভাষায় এর পেছনে একটা’ গ্যাঁড়াকল’ দায়ী। সেটা কেমন জানতে চাইলে বলেন, রেলবস্তি থেকে উচ্ছেদের পর তাঁরা শহরের বাইরে গেছেন বটে তবে তাঁরা ওই এলাকার ভোটার হননি। এখনো ভোটার সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের।

এ জন্য করোনাকালে চার আনারও কোনো সহায়তা পাননি। ওখানকার মেম্বার-চেয়ারম্যানকে বললে বলেন, ‘আপনারা সিটির ভোটার, সেখানে যোগাযোগ করেন।’ আবার এখানে এলে বলে, ‘তোমরা তো এখন এখানে থাকো না। ওখানে আলোচনা করো।’
রফিকের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় যেন অমোঘ বাস্তবতার তুলে ধরলেন। তাঁর ভাষায়, ‘করোনা তো রাতারাতি চইলে যাবে না। এসব মাইনে নিয়েই যুদ্ধ করতি হবে, অবশ্য তা আমাগোর জন্যি এট্টু কঠিনই।’