আবদুল জব্বারের বলীখেলার ১১৬ তম আসর বসবে ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে
আবদুল জব্বারের বলীখেলার ১১৬ তম আসর বসবে ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে

১১০ বছর আগে যেমন ছিল জব্বারের বলীখেলা

‘দেখিতে দেখিতে স্থানটি লোকারণ্যে পরিণত হয়। বেলা দশটার পর মল্লগণ (বলী) আসরে অবতীর্ণ হইতে থাকে। ...বেলা দশটার পর হইতে জনতার ভিড় এত বাড়িতে থাকে যেন তখন রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঘোড়া চলাচলও প্রায় বন্ধ হইয়া যায়। খেলা আরম্ভ হইলে মল্লগণ রঙ্গস্থলে অবতীর্ণ হইয়া বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করিতে থাকে। মল্লগণের মধ্যে একজন অন্যজনকে “চিৎপট্কন” দিতে পারিলেই তাহার জিত হইল।’

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলার এই বর্ণনা আজ থেকে ১১০ বছর আগের। ১৩২২ বঙ্গাব্দের (১৯১৫ সাল) অনুষ্ঠিত বলীখেলা ঘিরে মেলা ও শহরের মানুষের উন্মাদনা-আগ্রহ নিয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতবর্ষের মাসিক সাহিত্য সাময়িকী প্রবাসী–এর আষাঢ় মাসের সংখ্যায়। এই লেখার লেখক ছিলেন মোহিনীমোহন দাস। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হওয়া কমল চৌধুরী সম্পাদিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে লেখাটি সংকলিত করা হয়।

আবদুল জব্বারের বলীখেলার মূল পর্ব ১২ বৈশাখ তথা আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে। তিন দিনব্যাপী মেলার শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। চলবে শনিবার পর্যন্ত।

চট্টগ্রামের বকশিরহাটের আবদুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালে এই বলীখেলার প্রবর্তন করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণ ও যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে কুস্তি বা বলীখেলা শুরু করেছিলেন লালদীঘি মাঠে। কালের বিবর্তনে এই বলীখেলা এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। হয়েছে এখানকার বাসিন্দাদের আবেগের অংশ। রূপ লাভ করেছে প্রাণের মেলায়।

শত বছর পার হয়ে গেলেও বলীখেলা নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের আবেগ একটুও কমেনি। এখনো এই বলীখেলা নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষের আগ্রহ ও উত্তেজনার কমতি নেই। এই শহরের ধনী-গরিবসহ প্রায় সবাই অপেক্ষায় থাকেন বলীখেলা এবং একে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হওয়া লোকজ মেলার জন্য।

প্রবাসী পত্রিকায় মোহিনীমোহন দাস লিখেছেন, ‘“গাজনের ঢাকে” কাঠি পড়িলে যেমন পূর্বকালে চড়কের সন্ন্যাসীদের পিঠ সুড়সুড় করিত, চৈত্র মাসে চট্টগ্রামের বলীদের মধ্যেও তেমনি একটি উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়। এজন্য সম্পন্ন হিন্দু ও মুসলমানগণের মধ্যে অনেকেই রাশি রাশি অর্থ ব্যয় করিয়া থাকেন। সমস্ত জিলা ব্যাপিয়া কতগুলি “বলীখেলা” হয় তাহার সংখ্যা করা দুরূহ। এক চট্টগ্রাম নিজ সহরেই ১৫/২০টি খেলার “থলা” (স্থল) হইয়া থাকে। তাহাতে দেশের নানা স্থান হইতে বলীগণ আসিয়া নিজ নিজ দক্ষতা দেখাইয়া যথাযোগ্য পারিতোষিক লাভ করিয়া থাকে।’

বিভিন্ন স্থানে বলীখেলার আয়োজন করা হলেও সবগুলোর মধ্যে আবদুল জব্বারের বলীখেলা সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মত দিয়েছিলেন মোহিনীমোহন দাস। তাঁর মতে, ‘সুবে বাংলার অন্যান্য জিলায় এরূপ সমারোহে মল্লক্রীড়া অনুষ্ঠিত হয় কি না তাহা জানি না। বাল্যকালে বঙ্গদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ নগরী কলিকাতায় এবং যৌবনে ঢাকায় বাসকালে ২/১টি পশ্চিমী পালোয়ানের কুস্তী-ক্রীড়ার অভিনয় দর্শন করিয়াছি, কিন্তু এত সমারোহ ও এত আড়ম্বর তাহাতে দেখি নাই। এবং সেখানে মল্লক্রীড়া এরূপ কৌলিক “বারমাসে তের পার্বণের” পর্যায়ভুক্ত নহে। এখানকার মল্লক্রীড়ার (বলীখেলার) অনুষ্ঠাতারা প্রত্যেক বৎসর নির্দিষ্ট দিনে এই ব্যাপারের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। পিতার অনুষ্ঠান পুত্রে রক্ষা করিয়া আসিতেছে।’

শুরু থেকে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যদিও লেখক উল্লেখ করেছেন, ১৩২২ বঙ্গাব্দে মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৩ বৈশাখ। ‘চট্টগ্রাম শহরের ঠিক বক্ষঃস্থলে পুরাতন কাছারির ইমারাতের নিম্নস্থ ময়দানে এই খেলার স্থান করা হইয়া থাকে। খেলার মূল মঞ্চের পাশে নিমন্ত্রিত দর্শকদের জন্য সামিয়ানা খাটাইয়া বসার ব্যবস্থা করা হতো’ বলে লেখায় উল্লেখ করেছিলেন মোহিনীমোহন দাস। আর অন্য দর্শকেরা চারপাশে দাঁড়িয়ে, বসে, গাছে-ছাদে চড়ে বলীখেলা দেখতেন।

বলীখেলা ঘিরে দিনভর কী কী হতো তার বিবরণ দিয়েছিলেন ওই লেখায়। শহরে তখন সব আলাপ-আলোচনা বলীখেলা ঘিরে। বলীদের নিয়ে তুমুল আগ্রহ থাকে শহরের লোকজনের। এমনকি অফিস-আদালত দুপুরের পর ছুটি হয়ে যেত। তিনি লিখেছেন, ‘খেলার দিন রাত্রি প্রভাতের পূর্ব হইতে চট্টগ্রামের স্থানীয় ডোম বাদ্যকরগণের ঢোল কাড়া সানাইয়ের মিশ্রিত একঘেয়ে আওয়াজে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়া উঠিতে থাকে। এবং ঘন ঘন বোমের আওয়াজ হইতে থাকে।

‘...কোন বলী বড়, কাহার “তাকত” বেশি, কাহার সঙ্গে কাহার কুস্তী হইবার সম্ভাবনা, কে কাহাকে হারাইবে, ইত্যাকার কোলাহলে শহর মুখরিত হইয়া উঠে।’

এখন যে রকম খেলার সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা ধরনের পণ্যের পসরা নিয়ে আসেন দোকানিরা। ১১০ বছর আগে অনুষ্ঠিত মেলায়ও নানা স্থান থেকে দোকানিরা এসে মেলার উপযোগী দোকান সাজাতে আরম্ভ করতেন বলে লেখায় উল্লেখ করেছিলেন মোহিনীমোহন দাস। মেলায় “নাগরদোলা”, “রাধাচক্র”, এমনকি ছোটখাটো সার্কাসের দলও আসে।

বলীখেলা উপলক্ষে বসে তিন দিনের মেলা। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্যের পসরা নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা

জব্বারের বলীখেলার মূল আকর্ষণ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বলীরা। খেলার মঞ্চে বলীদের আগমন ও বরণ করে নেওয়ার চিত্র বর্ণনা দিয়ে লেখক লেখেন, ‘ক্রমে বলীগণ আসিয়া উপস্থিত হয়। এক একজন বলীর সহিত তাহার সহচর সাথী প্রায় ১০০/১৫০ লোক দলবদ্ধ হইয়া আগমন করে। রঙ্গস্থল হইতে ঢোল বাজাইতে বাজাইতে যাইয়া তাহাদিগকে “থলার (মূল মঞ্চ)” মধ্যে আগবাড়াইয়া আনিতে হয়। একে দুয়ে, দশে বিশে, দলে দলে প্রায় ৫০০০ দর্শক ক্রীড়াস্থলে সমবেত হয়।’

আবদুল জব্বারের বলীখেলায় কে জিতছেন, কে হারছেন তা নিয়ে উপস্থিত দর্শকদের তেমন কোনো মাথাব্যথা থাকে না। তাঁরা খেলার পুরোটা সময়জুড়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মশগুল থাকেন। সে বর্ণনাও তুলে ধরেছেন লেখক, ‘মল্লগণের মধ্যে একজন অন্যজনকে “চিৎপট্কন” দিতে পারিলেই তাহার জিত হইল। কোন বলী কাহাকেও হারাইতে পারিলে উপস্থিত জনতার মধ্য হইতে যে গভীর আনন্দধ্বনি উত্থিত হয় তাহাতে গগন বিদীর্ণ হইবার উপক্রম হয়।’ এখনকার মতো তখনো যে বলী জয়লাভ করতেন তাঁকে যথোপযুক্ত বস্ত্র ও অর্থ পুরস্কার দেওয়া হতো। সূর্য ডোবার আগেই ওই সময় খেলা শেষ হয়ে যেত বলে লেখায় উল্লেখ করা হয়েছিল।

চট্টগ্রামের এই বলীখেলা নিয়ে লেখকের উচ্ছ্বাস থাকলেও খেলার ব্যাপ্তি ও ধরন নিয়ে কিছুটা হলেও হতাশা ছিল। এখানকার বলীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন মনমোহিনী দাশ। লেখকের লেখায় তা ধরা পড়ে এভাবে, ‘দুঃখের বিষয় ঢাকার, কলিকাতার ও পশ্চিমী পালোয়ানগণের খেলার প্রতিযোগিতায় প্রতিপক্ষগণ একে অন্যেকে হারাইবার জন্য যে-সকল অপূর্ব কৌশল (প্যাঁচ) দেখাইয়া থাকে, এক এক জোড়া মল্লের খেলায় যেরূপ ২/৪ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়, এখানকার মল্লগণের খেলায় তাহার অনুরূপ বড় বেশী কিছু দেখিতে পাওয়া যায় না—এক এক জোড়ার খেলায় ১০/১৫ মিনিটের বেশি সময় লাগে না।...এখানে কুস্তী কসরৎ শিক্ষার তেমন কোন নির্দিষ্ট “আখড়া” নেই।’

অবশ্য তিনি আশাবাদী ছিলেন ভবিষ্যতে খেলার আয়োজনকারীরা বলীদের উন্নতির জন্য ঢাকা থেকে নামজাদা পালোয়ানদের এনে বলী খেলার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। তবে শত বছর পার হলেও সে আশা পূরণ হয়নি। কেননা এখনো বলীরা নিজেরা নিজেরা প্রশিক্ষণ নিয়ে খেলতে আসেন। লিখেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের বলীখেলার ভিতর যে চেতনাটুকু এখনও ক্ষীণ দীপালোকের মত জ্বলিতেছে তাহাতে কিঞ্চিৎ উৎসাহের তৈলসেক করিয়া যদি ইহাকে সর্বত্র এইরূপ সচেতন করা যায় এবং পূর্বকালের ব্যায়াম কৌশলপূর্ণ ক্রীড়াদি পুনরায় নিঃসঙ্কোচ গ্রহণ করিয়া আমাদের ভাবী বংশধরগণের ব্যায়ামের ব্যবস্থা করা যায়, তবে এই পোড়া বাংলায় আবার স্বাস্থ্যের উজ্জ্বলতেজ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিতে পারে।’