নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মনের বড় ছেলে স্বপন চন্দ্র বর্মণ। পাশে স্বপনের মা শান্তি রানী। গত মঙ্গলবার বিকেলে পঞ্চগড়ের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকায়
নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মনের বড় ছেলে স্বপন চন্দ্র বর্মণ। পাশে স্বপনের মা শান্তি রানী। গত মঙ্গলবার বিকেলে পঞ্চগড়ের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকায়

‘বাবার পাঞ্জাবির এক টুকরা কাপড় খুঁজে পেলেও মাকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম’

‘নৌকাডুবির সময় আমার বাবার পরনে যে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিটা ছিল, ওইটা টরে কাপড়ের। আমার মনে হয় পানিতে ডুবলেও ওই কাপড়টা ১০ বছরেও নষ্ট হবে না। এ জন্য আশায় ছিলাম বাবার লাশের চিহ্ন হিসেবে অন্তত কাপড়টা পাওয়া যাবে। বাবার পাঞ্জাবির এক টুকরা কাপড় খুঁজে পেলেও মাকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। ওই ঘটনায় আমার দুই বোনসহ পাঁচজন স্বজনের লাশ পেয়েছি। কিন্তু বাবাকে পাইনি। তখন থেকেই মা মাঝেমধ্যে কেমন জানি এলোমেলো কথা বলেন। নিজের হাতে বাবার সৎকারও করতে পারলাম না। তিন বছর হলো, মনে হয় না আর পাওয়া যাবে।’

কথাগুলো বলছিলেন তিন বছর আগে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মণের (৬৩) বড় ছেলে স্বপন চন্দ্র বর্মণ (৪০)। এ সময় তাঁর দুচোখে পানি ছলছল করছিল। পাশে বসে নির্বাক হয়ে কথাগুলো শুনছিলেন স্বপনের মা শান্তি রানী (৬১)। কথা শুনতে শুনতে একবার বলে উঠলেন, ‘মানুষটাক আর পানোনি বাপু।’ এ সময় তাঁর দুচোখের কোণে পানি ছলছল করছিল।

মঙ্গলবার বিকেলে সরেন্দ্র নাথের বাড়ির বাইরের উঠানে বসে কথা হয় তাঁর স্ত্রী ও বড় ছেলের সঙ্গে। নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মণ পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকার বাসিন্দা।

মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাই, বেয়াইসহ ছয় স্বজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ। নৌকায় গাদাগাদি করে মানুষ ওঠায় সাতজনই ছিলেন খুব কাছাকাছি। মাঝনদীতে নৌকাডুবিতে তলিয়ে যান তাঁরা। এ সময় বিনয় চন্দ্র বর্মণ (৪২) নামে তাঁদের এক স্বজন সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারলেও হারিয়ে যান অন্যরা। এরপর উদ্ধার অভিযানে বেয়াই, দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাইসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ।

নৌকাডুবির তিন বছরেও নিখোঁজ সরেনের জন্য অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না স্ত্রী-সন্তানদের। বাবাকে জীবিত অথবা মৃত খুঁজে পেতে এখনো মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে ঘোরেন তাঁরা। এমনকি নদীর ধারে গিয়ে একাধিকবার করেছেন গঙ্গাপূজা।

ঘটনার দিন দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের পাশে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশই বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এতে ৭১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ঘটনার চতুর্থ দিন পর্যন্ত নৌকাডুবির ঘটনায় ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। এরপর জেলা প্রশাসনের করা নিখোঁজদের তালিকায় ছিলেন এক শিশুসহ তিনজন।

এরপর ঘটনার দেড় মাসের মাথায় নৌকাডুবির স্থান থেকে প্রায় ৫০ গজ দক্ষিণে নদীর বালুর নিচ থেকে ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২) নামে নিখোঁজ এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ৪৭ দিনের মাথায় কাছাকাছি স্থানে বালুর নিচ থেকে জয়া রানী (৪) নামের এক শিশুর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ নিয়ে নৌকাডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখন নিখোঁজের তালিকায় রয়েছেন শুধু সরেন্দ্র নাথ বর্মণ।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ (মাঝের অংশ) নৌকাটিতে মোট ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। নৌকাডুবির পর সাঁতরে পাড়ে ওঠেন ছয়জন, জীবিত উদ্ধার হন ২৭ জন। এরপর লাশ উদ্ধার হয়েছে ৭১ জনের এবং নিখোঁজ রয়েছেন ১ জন।

নৌকাডুবির ঘটনার পর আউলিয়ার ঘাট এলাকায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। মঙ্গলবার বিকেলে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটের নৌকাডুবির স্থান ঘুরে দেখা যায়, ঘটনার দিনের তুলনায় অনেকটাই কম করতোয়ার পানি। নদীর ওপর চলছে দুটি (ওয়াই আকৃতির) সেতু নির্মাণের কাজ। তবে নৌকা দিয়ে নদী পারাপার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, আউলিয়ার ঘাটে গত বছরের নভেম্বর মাসে মোট ৮৯১ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। মাড়েয়া ডাঙ্গাপাড়া এলাকায় সেতু দুটির সংযোগ সড়কে ওয়াই আকৃতি যুক্ত হবে। দুটি সেতুর মধ্যে একটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে চপড়ামারী এলাকা এবং অপরটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে নিশানডোবা-বোদেশ্বরীর সঙ্গে যুক্ত হবে। দুটি সেতুর মধ্যে একটি ৩৪৫ দশমিক ৪ মিটার এবং অপরটি ৫৪৫ দশমিক ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের হবে। এর চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছে ১১০ কোটি টাকা।

এলজিইডি পঞ্চগড় জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহমুদ জামান বলেন, আউলিয়ার ঘাটে দুটি সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। সেতু দুটির সংযোগ সড়ক ওয়াই আকৃতির হবে। ১১০ কোটি টাকা চুক্তিমূল্যে ইতিমধ্যে ৫৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজের সময়সীমা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ–সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। আশা করা যায়, ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্মাণকাজ শেষ হবে।