
২০১৮ সালের মার্চে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে ভেনম রিসার্চ সেন্টার। এর এক বছর আগে, ২০১৭ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সাপে কাটাকে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের অবহেলিত ট্রপিক্যাল রোগ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই শুরু হয় প্রতিষেধক তৈরির উদ্যোগ।
চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেনম (প্রতিষেধক) তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে দেশের একমাত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ভেনম রিসার্চ সেন্টার। আগামী দুই মাসের মধ্যে সাপের বিষ থেকে সংগৃহীত অ্যান্টিবডি ইঁদুরের শরীরে প্রয়োগ করা হবে। পরীক্ষায় সাফল্য এলে পরবর্তী ধাপে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পথে এগোবে গবেষণা। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেও প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এক বছর ধরে কোনো অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় গবেষণা কার্যক্রম কার্যত থমকে গেছে।
২০১৮ সালের মার্চে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে ভেনম রিসার্চ সেন্টার। এর এক বছর আগে, ২০১৭ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সাপে কাটাকে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের অবহেলিত ট্রপিক্যাল রোগ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই শুরু হয় প্রতিষেধক তৈরির উদ্যোগ।
প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মক্ষম পরিকল্পনার (অপারেশনাল প্ল্যান) আওতায় চলছিল। প্রতিবছর কর্মীদের বেতন, সাপ সংগ্রহ, খাবার, যন্ত্রপাতি কেনাসহ গবেষণার যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হতো অপারেশনাল প্ল্যানের বাজেট থেকে। পর্যায়ক্রমে পরীক্ষাগারের যন্ত্রপাতিও কেনা হয়। ২০১৯ সালের শুরুতে যেখানে সাপ ছিল ৫৬টি, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০–এ।
কেন প্রয়োজন দেশীয় অ্যান্টিভেনম
বাংলাদেশে প্রতিবছর বর্ষায় চন্দ্রবোড়া, গোখরা, কাল কেউটে, কিং কোবরা ও সবুজ বোড়ার মতো সাপের কামড়ের ঘটনা বাড়ে। এখন উপজেলা পর্যায়ে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনম ভারতের সাপের বিষ থেকে তৈরি, যা সব সময় কার্যকর হয় না। চিকিৎসকের বদলে কবিরাজ বা ঝাড়ফুঁকের ওপর নির্ভরতার কারণে প্রতিবছর ছয় হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। সাপে কাটার শিকার হন প্রায় ছয় লাখ মানুষ। জরিপ অনুযায়ী, ৮৬ শতাংশ রোগী অপচিকিৎসার শিকার হন, মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে যান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৮ সালের মে মাসে সাপে কাটাকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে ঘোষণা করে এবং প্রতিষেধক তৈরির উদ্যোগ নিতে সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানায়। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশে এই গবেষণা শুরু হয়।
চমেক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং ভেনম রিসার্চ সেন্টারের মুখ্য গবেষক অনিরুদ্ধ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে যেসব অ্যান্টিভেনম ব্যবহৃত হয়, তা ভারতের তৈরি। কিন্তু অঞ্চলভেদে বিষের গঠন ও বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য থাকায় এসব ওষুধ সব ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না। দেশীয় ১০ ধরনের বিষধর সাপের অ্যান্টিভেনম তৈরির লক্ষ্যেই আমাদের এই গবেষণা।’
প্রাথমিকভাবে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ অনেক দূর এগিয়েছে বলে জানান তিনি। কিন্তু এক বছর ধরে ওপি বন্ধ থাকায় গবেষণার গতি থমকে গেছে।
২০২৩ সালের জাতীয় সর্পদংশন জরিপ বলছে, প্রতি লাখে ২৪৪ জন সাপের কামড়ের শিকার হন। মৃত্যুর হার লাখে ৪-৫ জন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৯৫ শতাংশ গ্রামীণ এলাকা থেকে। খুলনা ও বরিশাল বিভাগে দংশনের হার বেশি।
৪০০ সাপের গবেষণাগার
বাংলাদেশে ৮০টির বেশি সাপের প্রজাতি রয়েছে, এর মধ্যে ৩৩টি বিষধর। ভেনম রিসার্চ সেন্টারে এসব সাপ সংগ্রহ করে গবেষণা চলছে। চমেকের সহযোগিতায় গবেষণায় যুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন, মেডিসিন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ ও জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষণা সহযোগী মিজানুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে ৬ ধরনের ১০ প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে আমাদের কাছে। এর মধ্যে ৬০টির বেশি চন্দ্রবোড়া। এগুলোর খাবার খরচেই মাসে এক লাখ টাকার বেশি প্রয়োজন হয়।’
সাপের খাবার হিসেবে ইঁদুর ব্যবহার হয়, তাই ইঁদুরও প্রতিপালন করা হয়। তিনি বলেন, ‘এখন চার শ সাপ পালন করছি, কিন্তু আর কত দিন চলবে, জানি না।’
শেষ ধাপে রাসেলস ভাইপার প্রতিষেধক
ভেনম রিসার্চ সেন্টারে সংগৃহীত রাসেলস ভাইপারের বিষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল ইমিউনিজেশন ল্যাবে পাঠানো হয়। সেখানে মুরগি ও ছাগলের শরীরে বিষ প্রয়োগ করে অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই অ্যান্টিবডি শুকিয়ে, ডায়ালাইসিসসহ নানা ধাপ পার করা হচ্ছে।
অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, ‘পরবর্তী ধাপে ইঁদুরের শরীরে প্রয়োগ করা হবে এই অ্যান্টিবডি। কাজ করলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পথে এগোব আমরা। আশা করছি, দুই মাসের মধ্যে ইঁদুরে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করা যাবে।’
সচিব বরাবর চিঠি দিয়ে আমরা এই গবেষণাকে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানিয়েছি। কীভাবে এটি পরিচালিত হতে পারে, সেই অর্গানোগ্রামও জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো সাড়া মেলেনিঅধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ, মুখ্য গবেষক, ভেনম রিসার্চ সেন্টার
প্রতিষেধকের অভাবে মৃত্যু
২০২৩ সালের জাতীয় সর্পদংশন জরিপ বলছে, প্রতি লাখে ২৪৪ জন সাপের কামড়ের শিকার হন। মৃত্যুর হার লাখে ৪–৫ জন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৯৫ শতাংশ গ্রামীণ এলাকা থেকে। খুলনা ও বরিশাল বিভাগে দংশনের হার বেশি।
২০২৪ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ২৮৩ জন রোগী, মারা গেছেন তিনজন। অ্যান্টিভেনম পেয়েছেন মাত্র ৫২ জন। ২০২৩ সালে ভর্তি ছিলেন ১ হাজার ৩৬৮ জন, মারা যান দুজন।
চমেক হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, ‘বর্তমানে কেবল কোবরা ও চন্দ্রবোড়ার কামড়ের ক্ষেত্রেই অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়। অন্য বিষধর সাপের প্রতিষেধক নেই।’
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
এক বছর ধরে অপারেশনাল প্ল্যান বন্ধ থাকায় গবেষণার মূল তহবিল বন্ধ হয়ে গেছে। আগে বছরে এক কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ পেত প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এখানে গবেষকসহ বেতনভুক্ত কর্মী রয়েছেন ১৫ জনের মতো। জায়গার অভাব, ল্যাবরেটরির সংকট, যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে থাকা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে।
অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, ‘সচিব বরাবর চিঠি দিয়ে আমরা এই গবেষণাকে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানিয়েছি। কীভাবে এটি পরিচালিত হতে পারে, সেই অর্গানোগ্রামও জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (গবেষণা ও পরিকল্পনা) আফরিনা মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপারেশনাল প্ল্যান এখন বন্ধ আছে। গবেষণা প্রকল্পটি এখনো রাজস্ব খাতে যায়নি। প্রশাসনিক অনুমোদন পেলে সমস্যার সমাধান হবে। আমরা ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিতে বলেছি।’
আফরিনা মাহমুদ বলেন, এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষেধক তৈরি দেশের জন্য খুবই দরকারি উদ্যোগ। এটি চালিয়ে যাওয়া উচিত।