
ফাগুনের সকালে প্রখর রোদে গা পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তার ওপর বাজারে লোকজনের ভিড়ে গরমের তীব্রতা আরও বেশি। প্রকৃতির এই রুক্ষ পরিবেশের সঙ্গে যোগ হয়েছে বাজারের উত্তাপ। এতে সাধারণ মানুষের যেন নাভিশ্বাস উঠেছে।
মাইনুল ইসলাম তাঁর ছোট বাচ্চা ও স্ত্রীকে সঙ্গে করে গত শনিবার বাজার করতে এসেছিলেন বরিশাল নগরের পোর্ট রোডে। মাইনুল একটি ব্যাংকের কর্মচারী। থাকেন নগরের আমতলী মোড়ে পানির ট্যাংক এলাকায়। বাজারে মুরগি কেনার জন্য, এ দোকান ও দোকান ঘুরে দরদাম মেলাতে পারছিলেন না। মুরগির দাম শুনে কপালে ভাঁজ তাঁর। শেষে ফুটপাতে মুরগির পা আর গিলা–কলিজার দোকানে উঁকি দিয়ে জানতে চান, ‘কেজি কত?’ দোকানি বললেন, ‘১৩০।’ আগে তো ৭০ টাকা ছিল জানিয়ে মাইনুল বললেন, ‘কমে হবে?’ দোকানদার চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘যদি নেন, একদাম ১৩০।’ মাইনুল কিছুটা বিরক্তির সুরে বললেন, ‘এইয়ারও এত্ত দাম!’
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মাইনুল ইসলাম মুচকি হাসেন। এই সূত্র ধরেই আলাপ। মাছ, মাংসের দাম এত বেড়েছে যে এখন আর কিনতে পারেন না মাইনুল। যা বেতন পান তার অধিকাংশই বাসাভাড়া, বাজারসদাই আর চাল–ডালে চলে যায়। এরপর কাঁচাবাজার, মাছ, মাংস কেনার মতো টাকা তেমন আর হাতে থাকে না।
বাজারে এসে হিমশিম খান। মনটা খারাপ হয়ে যায় যখন সাধ আর সাধ্য মেলাতে পারেন না। তিন সদস্যের পরিবারে মাইনুল গরুর মাংস আর ভালো মাছ কেনা বাদ দিয়েছেন অনেক দিন। তারপরও আগে ব্রয়লার মুরগি দিয়ে মোটামুটি পুষ্টির চাহিদা মেটাতেন। কিন্তু এখন তারও যে দাম বেড়েছে, কেনার উপায় নেই।
মাইনুল বলেন, বাজারে এলে মন খারাপ হয়ে যায়। সব জিনিসের এত্ত দাম যে দিন দিন সবকিছু সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। মাছ, মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগে ব্রয়লার দিয়ে পুষ্টির চাহিদা মেটানো যেত, এখন তারও উপায় নেই। তাই মুরগির পা, গিলা, কলিজার দাম দেখছিলাম। অন্তত এ দিয়ে দিনগুলো পার করা আর কি!’ এসব কথা বলার সময় তাঁর চোখে হতাশার ছাপ ফুটে ওঠে।
মাইনুলের সঙ্গে কথা শেষ করে পাশেই মুরগি বিক্রেতার দোকানে কথা হয় দোকানমালিক মিজান হাওলাদারের সঙ্গে। মুরগির দরদাম জানতে চাইলে তিনি জানান, ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৩০। একদাম; আর সোনালি ৩০০, লেয়ার ২৮০ টাকা।
দাম এত কেন—জিজ্ঞাসা করলে মিজান হাওলাদার বললেন, মুরগির খাবার, ওষুধের দাম বাড়তি। শীতে অনেক খামারের মুরগি মরে গেছে। বাচ্চার দামও অনেক বাড়তি। বিদ্যুৎ বিল বাড়ছে, ট্রাকে আনা-নেওয়ার খরচ বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘কোনডা কম আছে কন দেহি? আমরা কী করমু। আমাগো তো বেশি দামে কেনা লাগে।’ মিজানের স্বগতোক্তি, ‘বয়লার (ব্রয়লার) মুরহার দাম ২০০ টাকার উপ্রে গ্যাছে এইয়্যা জীবনে হুনি নাই।’ দাম বাড়ায় বেচাবিক্রি কমে গেছে অনেক। মিজান বললেন, ‘আগের অর্ধেক বেচা কিনাও এহন নাই। ব্যবসা লাডে (খোয়া) ওডার অবস্থা পালা এহন।’
পোর্ট রোডের মাছের বাজারের পাশের গলিতে গরুর মাংস বিক্রেতাদের হাঁকডাক শুনে জানতে চাই, ‘ভাই কেজি কত?’ একজন উঁচু গলায় বললেন, ‘ভ্যাজাল নাই, কচি গরু, একদাম ৭৫০।’ সেখানের দোকানগুলোতে বেশ কিছু ক্রেতাকে দরদাম করতে দেখা যায়। কিন্তু কিনছিলেন খুব কমসংখ্যক ক্রেতা। দাম শুনে চোখ কপালে তুলে হেঁটে যাচ্ছিলেন আসাদুজ্জামান নামের এক ক্রেতা। ‘কিনবেন না?’ জিজ্ঞেস করতেই কপাল ভাঁজ করে বললেন, ‘এইয়্যা কি আমাগো মতো মাইনসের কেনার সুযোগ আছে!’
মাংসের বাজারের এই হাল দেখে ইচ্ছা হলো মাছের অবস্থা জানতে। একটু পূর্ব দিকে এগিয়ে দেখা গেল ডালায় জীবিত পাঙাশ, তেলাপিয়া। এক গামলায় কিছু মরা পাঙাশও।
আরেক গামলায় মাঝারি আকারের জীবিত পাঙাশ। দরদাম জানতে চাইলে দোকানি বললেন, ‘বড়টা (মাঝারি আকারে জীবিত পাঙাশ) ২০০ টাকা। আর ছোটটা (ছোট আকারের মরা পাঙাশ) ১৬০ টাকা। পাঙাশের এত দাম?’ দোকানি মাছ সাজাতে সাজাতে বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘দাম কোনডার কম আছে কন দেহি।’ তেলাপিয়ারও একই অবস্থা ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজি।
বাজার থেকে বের হয়ে সবজির দাম কেমন আঁচ করতে মূল সড়কের পাশের দোকানগুলোতে গিয়ে যা জানা গেল তা আরও ভয়ংকর। করলা ১৫০ টাকা, কাঁচা কলার হালি ৬০, ঢ্যাঁড়স ৮০ টাকা।
সবজির দাম শুনে আরেকবার হোঁচট খাওয়ার অবস্থার মধ্যেই চোখ যায় সেই গিলা, কলিজা, পা ডালায় সাজিয়ে ফুটপাতের আরেক নারী দোকানির দিকে। নাম ফাতেমা বিবি। দোকানের সামনে ভিড়। দামাদামি করে অনেকে কিনছেন। ফাতেমা বিবি এক ঘণ্টায় ৬০ কেজি বিক্রি করে ফেলেছেন। সাবিনা ইয়াসমিন নামের এক ক্রেতা একটু দাম কমাতে অনুনয় করছিলেন। বলছিলেন, ‘খালাম্মা ১০টা টাকা কম রাখেন, এক কেজি দেন।’ ফাতেমা বিবি নাছোড়বান্দা। বললেন, ‘মা এক টাকাও কমাইতে পারমু না, নেলে নেও, না নেলে কিচ্ছু হরার নাই।’ সাবিনা বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘দেন দেন এক কেজি দেন।’
সাবিনার সঙ্গে আলাপে জানা গেল তাঁর বাড়ি বাকেরগঞ্জ শহরে। স্বামী মারা গেছেন বছর ছয়েক আগে। তিন ছেলে নিয়ে থাকেন ভাড়া বাসায়। টিউশনি করিয়ে ছেলেদের পড়াশোনা চালান, সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন। তাঁর মুখে হাসি। তিনি বলেন, ‘কী করব, ছেলেদের তো একটু পুষ্টিকর খাবার দিতে হয়। এই গিলা, কলিজা কম দামে নিয়ে তা দিয়ে আলু, ডাল দিয়ে রান্না করে সামনে দিই।’ সাবিনার উজ্জ্বল হাসিটা ম্লান হয়ে যায়। সূর্যটা তখন মাথার ওপরে, তাপের তীব্রতা তখন আরও অসহনীয় লাগছিল।