চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বড় দিঘির পাড় থেকে ভাটিয়ারী যাওয়ার সংযোগ সড়ক ধরে কিছু দূর এগোলেই ৩ নম্বর বাজার। হাটহাজারী উপজেলার এই বাজার পেরোতেই সড়কের পশ্চিম পাশে ৫০ থেকে ৬০ ফুট উচ্চতার একটি পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে আধা পাকা কিছু বসতঘর। ফটক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখা গেল বসতি সম্প্রসারণের জন্য কাটা হচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশ।
খালি চোখে বিশাল পাহাড় দেখা গেলেও ৩ নম্বর বাজার এলাকার এই পাহাড়কে বাংলাদেশ সার্ভে বা বিএস জরিপে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে ‘নাল’ জমি হিসেবে। স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ে যোগাযোগ করে জানা গেল, জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজার বিএস ৩৫৭৩ নম্বর দাগে থাকা পাহাড়টির আয়তন প্রায় সাড়ে ৭ একর। বিএস জরিপে ভুলবশত ব্যক্তিমালিকানাধীন এই পাহাড়টিকে নাল শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও নাল বলতে সাধারণত নিচু সমতল কৃষিজমিকে বোঝায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশাল পাহাড়টির পাদদেশে বেশ কিছু বসতি গড়ে উঠেছে। পাহাড়টির ওপর বড় কোনো গাছপালা নেই। তবে ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। পাহাড়ের কিছু অংশে মাটি ধসে পড়ছে। ভূমি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ার পাহাড়ের অন্তত ১৬০ শতক টিলা শ্রেণির জমিকে ‘নাল’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বিএস জরিপে।
চট্টগ্রাম নগর এবং এর পাশের দুই উপজেলা হাটহাজারী ও সীতাকুণ্ডে দেড় শতাধিক পাহাড়-টিলাকে বিএস জরিপে ভুলভাবে শ্রেণিভুক্ত করার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব পাহাড়-টিলার জমির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৪০০ একর। তবে ১৯৭০ সালে জরিপ শুরুর সময় কত পরিমাণ জমির পাহাড়-টিলা এমন ভুলভাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছিল এবং কাটা হয়েছিল, সে হিসাব পাওয়া যায়নি। কোথাও এসব পাহাড়-টিলার পুরোটাই, কোথাও আবার অংশবিশেষকে ‘শণখোলা’, ‘নাল’, ‘খিলা’, ‘বাড়ি’ ইত্যাদি শ্রেণিতে নথিভুক্ত করা হয়েছে। সরকারি জরিপের এমন ভুলের সুযোগ নিয়ে চলছে পাহাড়-টিলা কেটে স্থাপনা নির্মাণ।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য অনুযায়ী, বিএস জরিপ শুরু হয় ১৯৭০ সালে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে (সংশোধিত) বলা হয়েছে, পাহাড় ও টিলা বলতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পার্শ্ববর্তী সমতল ভূপৃষ্ঠ থেকে উঁচু মাটি অথবা মাটি ও পাথর অথবা পাথর অথবা মাটি ও কাঁকড় অথবা অন্য কোনো কঠিন পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত স্তূপ বা স্থান এবং সরকারি রেকর্ডপত্রে পাহাড় বা টিলা হিসেবে উল্লিখিত ভূমিকে বোঝায়।
ভূমি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে শণ নামক উদ্ভিদ জন্মায়, সেটিকে শণখোলা বলা হয়। অকর্ষিত বা পতিত জমিকে বলা হয় খিলা।
পাহাড়টির ওপর বড় কোনো গাছপালা নেই। তবে ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। পাহাড়ের কিছু অংশে মাটি ধসে পড়ছে। ভূমি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ার পাহাড়ের অন্তত ১৬০ শতক টিলা শ্রেণির জমিকে ‘নাল’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বিএস জরিপে।
২০১০ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পাহাড়-টিলা কাটা নিষিদ্ধ। কেবল জাতীয় স্বার্থে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় কাটা যেতে পারে। তবে আইনে কড়াকড়ি থাকলেও জরিপে ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত হওয়া পাহাড়-টিলা কাটা বন্ধ করা কিছুটা কঠিন। এ ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক সোনিয়া সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি জরিপে ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত হওয়া পাহাড়-টিলা কাটা হলে এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় পরিবেশ অধিদপ্তরকে। পাহাড় কাটার অভিযোগে মামলা করা হলেও আদালতে প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, একটি ভূমি এলাকাকে আদালতে যতই পাহাড় বলা হোক, জরিপ-খতিয়ানে কীভাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে, সেটিই আদালত গুরুত্ব দেন।
চট্টগ্রামে পরিবেশ আদালতে নিযুক্ত রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হুমায়ুন কবির তালুকদার বলেন, জমির রেকর্ড যদি পাহাড়-টিলা হয়, নির্বাহী কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারেন। কাগজে-কলমে যখন কোনো ভূমি পাহাড় থাকে না, তখন কেউ সেটি কেটে সমান করে ফেললেও আদালতে প্রমাণ করা দুরূহ। পাহাড় কাটায় জড়িত ব্যক্তিরা কেবল জমির রেকর্ডের ভুলের কারণেই অনেক সময় পার পেয়ে যান।
চট্টগ্রাম নগরে কোনো ভবনের পরিকল্পনার অনুমোদন করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সংস্থাটি পাহাড়-টিলায় কোনো ধরনের ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেবে না—গত বছর এমন সিদ্ধান্ত হয় চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির এক বৈঠকে। তবে সিডিএর কর্মকর্তারা বলছেন, ভিন্ন নামে অনেক পাহাড়-টিলা শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রে মানা যায় না। বিশেষ করে জনবলসংকটের কারণে অনেক সময় সরেজমিন যথাযথ পরিদর্শন না করে কেবল জমির রেকর্ডপত্র দেখে নগরে ভবনের অনুমতি দেওয়া হয়। এই সুযোগ অনেকে কাজে লাগিয়ে পাহাড়-টিলা কেটে স্থাপনা নির্মাণ করেন।
চট্টগ্রাম নগরের আসকার দিঘির পাড়ের অন্তত ১২৭ ফুট উঁচু একটি জায়গা পরিচিত গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের পাহাড় নামে। বিএস জরিপে পাহাড়ের শূন্য দশমিক ৫৭৯ একর জমি শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে ‘বাড়ি’ হিসেবে। শ্রেণি হিসেবে পাহাড়-টিলা উল্লেখ না থাকার সুযোগে ২০২২ সালে পাহাড়ি জমিটিতে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। পাহাড় না কাটাসহ ৮৭টি শর্তে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ভবন নির্মাণের জন্য সেখানে টিন দিয়ে ঘেরাও করে পাহাড়টির বেশ কিছু অংশ কাটা হয়। সরকারি একাধিক সংস্থা অভিযান চালিয়ে পাহাড়টি কাটার সত্যতা পেয়েছে। এরপরও ভবনটির অন্তত ছয়তলার বেশি নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম খুলশী এলাকায় অবস্থিত রূপসী পাহাড়। প্রায় ৪০ ফুট উঁচু এই পাহাড়ের জমিও বিএস জরিপে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে ‘শণখোলা’ নামে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গত বছরের মাঝামাঝিতে পাহাড়টির মাটি কেটে পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু প্লট। চার ফুটের মতো উঁচু দেয়াল তুলে বিক্রির উদ্দেশে প্রস্তুত করা হয়েছে প্লটগুলো। গত বছরের ১৩ নভেম্বর পূর্ব নাছিরাবাদ মৌজার এই পাহাড়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতদেরও জরিমানা করা হয়েছে।
অভিযানে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ভূমির শ্রেণি পাহাড়-টিলা হলে তা কাটা বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তবে শণখোলার ক্ষেত্রে পরিবেশ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ কম। যদিও বাস্তবে পাহাড় হলে ব্যবস্থা নেওয়ার মৌখিক নির্দেশনা রয়েছে। তবে আদালতে গিয়ে এসব বিষয়ে বিপাকে পড়তে হয়, যার কারণে কর্মকর্তারা ঝামেলায় পড়তে চান না।
এই দুটি পাহাড়ের বাইরেও চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত থাকা অনেক পাহাড়-টিলা কেটে বাড়িঘর নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ‘শণখোলা’ শ্রেণিভুক্ত একাধিক পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার অভিযোগও রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের অসংখ্য অভিযানেও ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত থাকা এ ধরনের পাহাড়-টিলা কাটার তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়-টিলা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে সরকারি পাহাড়-টিলা। কয়েকটি ঘটনায় মামলাও করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু এ পর্যন্ত ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত করা কত পাহাড় চট্টগ্রামে কাটা হয়েছে, তার কোনো সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বা গবেষণার খোঁজ মেলেনি।
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণায় গুগল আর্থের ছবি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ২০১২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১ হাজার ২৯৫ হেক্টর এলাকার পাহাড় কাটা হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরে ১৯৭৬ সালে মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে নেমে আসে। এই সময়ে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়েছে, যা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ।
চট্টগ্রামের বড় দিঘির পাড় থেকে ভাটিয়ারী সংযোগ সড়ক ধরে হাটহাজারী উপজেলার ৩ নম্বর বাজার পেরিয়ে সামনে এগোলেই একটি সেতু। সেই সেতুর পশ্চিম পাশে নেমে যাওয়া একটি গ্রামীণ রাস্তা ধরে যেতে যেতে চোখে পড়ে অসংখ্য পাহাড়। প্রায় দেড় কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে দেখা যায় উঁচু একটি পাহাড়ের মাঝখানে কেটে সরু রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। সেটি দিয়ে ঢুকে আরেকটু সামনে যেতেই রয়েছে একটি পাহাড়, যেটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে পরিচিত মৈশামুড়া নামে। বিএস জরিপে জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজার ৩০৫৩ দাগে থাকা এই পাহাড়ের উচ্চতা স্থানভেদে ৫০ থেকে ১০০ ফুট। পাহাড়টির ওপর ঘন ঝোপঝাড় ও জঙ্গল। খালি চোখে বিশাল পাহাড় দেখা গেলেও বিএস জরিপে পাহাড়টি শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে শণখোলা হিসেবে। পাহাড়টি সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বলে জানান ভূমি কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম নগরের প্রবর্তক মোড় থেকে ২ নম্বর গেটের দিকে এগোলেই ডান পাশে বেশ উঁচু একটি পাহাড়। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড়টির ওপর রয়েছে উপাসনালয়, দোকানসহ নানা স্থাপনা। সরকারি জরিপে পাহাড়ি এলাকাটির প্রায় সাড়ে ২৪ একর জমি বাড়ি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বলে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদের রৌফাবাদ এলাকায় অবস্থিত মিয়ার পাহাড়। পশ্চিম ষোলশহর মৌজার এই পাহাড় ব্যক্তিমালিকানাধীন। সরেজমিনে দেখা যায়, বিশাল পাহাড়টির পাদদেশে বেশ কিছু বসতি গড়ে উঠেছে। পাহাড়টির ওপর বড় কোনো গাছপালা নেই। তবে ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। পাহাড়ের কিছু অংশে মাটি ধসে পড়ছে। ভূমি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ার পাহাড়ের অন্তত ১৬০ শতক টিলা শ্রেণির জমিকে ‘নাল’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বিএস জরিপে।
নগরের পশ্চিম ষোলশহর মৌজাতেই অবস্থিত টাংকির পাহাড়। পাহাড়টিতে অনেক বসতি গড়ে উঠেছে। এই পাহাড়ের সাড়ে তিন একরের বেশি জমি বাড়ি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বিএস জরিপে। একই মৌজায় বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের উত্তর পাশে অবস্থিত মীর হাসানের পাহাড় এলাকার ৯৬ শতক টিলাকেও ‘খিলা’ হিসেবে জরিপে শ্রেণিভুক্ত করার তথ্য মিলেছে ভূমি কার্যালয়ের নথিতে।
পাহাড় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটির সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার যেমন সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি অনেক প্রাণিকুলেরও এটি আশ্রয়স্থল। পাহাড় কাটা হলে এর প্রভাবে জীববৈচিত্র্য হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়, খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হয়।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল
চট্টগ্রামে ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত হওয়া পাহাড়-টিলার সবচেয়ে বেশি হাটহাজারী উপজেলায়। এই উপজেলাতেই পাহাড়-টিলা শ্রেণির ১ হাজার ২০০ একরের বেশি জমিকে শণখোলা, জঙ্গল, নাল, বাগান, খিলা ইত্যাদি শ্রেণিতে রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে। জঙ্গল উত্তর পাহাড়তলী, জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলী, জালালাবাদ, ছোট কাঞ্চনপুর ও জঙ্গল উদালিয়া মৌজায় আড়াই শর বেশি বিএস দাগে এসব পাহাড়-টিলা অবস্থিত। হাটহাজারী ভূমি কার্যালয়ের অধীনে থাকা এসব পাহাড়ের কিছু অবস্থিত চট্টগ্রাম নগরের ভেতরে।
হাটহাজারী উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের নথি অনুযায়ী, জঙ্গল উত্তর পাহাড়তলীর বিএস দাগ ১৫৩-এর ১০৩ একর জমি বাস্তবে পাহাড়-টিলা হলেও শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বাগান হিসেবে। একইভাবে জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজার দাগ নম্বর ৩০৬৬-এর চারটি খতিয়ানের আওতায় থাকা প্রায় ৮৩ একর পাহাড়-টিলা বিএস জরিপে রেকর্ড করা হয়েছে শণখোলা শ্রেণিতে।
হাটহাজারীর পার্শ্ববর্তী উপজেলা সীতাকুণ্ডেও বেশ কিছু পাহাড়-টিলা ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। সীতাকুণ্ড উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলাটিতে অন্তত ৮৫ দশমিক ৭৭ একর পাহাড় রেকর্ড করা হয়েছে শণখোলা হিসেবে। জঙ্গল ছলিমপুর, জঙ্গল লতিফপুর ও জঙ্গল ভাটিয়ারী—এই তিনটি মৌজায় ৩৮টি বিএস দাগে এসব পাহাড় রয়েছে। এর মধ্যে জঙ্গল ভাটিয়ারী এলাকায় থাকা বিএস দাগ-৫৩১-এ ৮ একরের বেশি পাহাড়ি জমিকে শণখোলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের বাইরে যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে এই সীতাকুণ্ড উপজেলা। এই উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর এলাকাতেই গত কয়েক দশকে শতাধিক পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করা হয়েছে। এসব পাহাড়ের বেশির ভাগই সরকারি মালিকানাধীন। ‘ছিন্নমূল’ পরিচয়ে কিছু ভূমিদস্যু চক্র পাহাড়গুলো কেটে এর দখল বিক্রি করে আসছে।
চট্টগ্রাম নগরে চান্দগাঁও ভূমি কার্যালয়ের অধীনে থাকা দুটি মৌজায় অন্তত ৩৪ দশমিক ৪৩ একর পাহাড়-টিলাকে বিএস জরিপে বাড়ি, খিলা, নাল শ্রেণিতে রেকর্ড করার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। একইভাবে ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত করা রয়েছে চট্টগ্রাম নগরের কাট্টলী ভূমি সার্কেলের অধীনে থাকা অন্তত ২১ দশমিক ১ একর পাহাড়-টিলা। এই এলাকায় অনেক জমি টিলা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবে সেখানে আবাসিক এলাকা নির্মাণ করা হয়েছে। নগরের বাকলিয়া ভূমি সার্কেলের অধীনে ৮ দশমিক ১৭ একর টিলাকে বিএস জরিপে বাড়ি, নাল, ঢালু হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করার তথ্য পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম নগরে সরেজমিনে পরিদর্শন করে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ২৭টি পাহাড়-টিলা খুঁজে পান। এগুলো শণখোলা, ভিটাসহ ভিন্ন শ্রেণিতে বিএস জরিপে রেকর্ড করা হয়েছে। গত বছরের ১৭ আগস্ট থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত সরেজমিনে এসব পাহাড় পরিদর্শন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয় থেকে একটি চিঠিতে বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অবহিত করা হয়। চিঠির সঙ্গে পাহাড়কে ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত করা ২৭টি স্থানের তালিকা সংযুক্ত করা হয়।
তালিকায় দেখা যায়, ভিন্ন নামে থাকা পাহাড়-টিলার আটটির অবস্থান নগরের পূর্ব পাহাড়তলী মৌজায়। উত্তর পাহাড়তলীতে রয়েছে ছয়টি। এর বাইরে চারটি পূর্ব নাছিরাবাদ মৌজায় অবস্থিত। বাকিগুলো জালালাবাদ এবং পশ্চিম ষোলশহর মৌজায়।
এ বছরের শুরুতে চট্টগ্রামের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ৩০তম সভায় ভিন্ন নামে পাহাড়-টিলা শ্রেণিভুক্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। বৈঠকে সিডিএর একজন প্রতিনিধি বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন স্থানে হলেও সিডিএ পাহাড়-টিলা হিসেবে চিহ্নিত স্থানে ভবনের প্ল্যান অনুমোদন করে না। তাই বাস্তবে পাহাড় বা টিলা হওয়া সত্ত্বেও রেকর্ডে অন্য নামে শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় পাহাড় কাটার সুযোগ তৈরি হয়।
বিএস জরিপে পাহাড়-টিলাকে ভিন্ন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক (ভূমি রেকর্ড) মো. মোমিনুর রশীদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, কেবল চট্টগ্রাম জেলা নয়, সম্প্রতি সিলেটে গিয়েও তাঁরা একই অভিযোগ পেয়েছেন। অর্থাৎ বাস্তবে পাহাড়-টিলা হলেও অনেক জমি রেকর্ড করা হয়েছে ভিন্ন নামে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ বিপুল পরিমাণ পাহাড়-টিলা ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম জেলায় যেসব পাহাড়-টিলা ভিন্ন শ্রেণিতে রেকর্ড করা হয়েছে, তার একটি তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। এই তালিকা তৈরি শেষ হলে পর্যায়ক্রমে এসব ভূমি আবার পাহাড়-টিলা শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে বসতি নির্মাণসহ নানা কারণে পাহাড় কাটা হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরে পাহাড় কাটার শুরু কবে, সেটি নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। ঐতিহাসিকদের ধারণা, ১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম শহরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমেই এর সূত্রপাত। ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম শহরের একটি মাস্টারপ্ল্যানে শহরকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয় এবং কিছু পাহাড় কেটে ও মাটি সরিয়ে নতুন বসতি গড়ার সুপারিশ করা হয়। এর ফলে সত্তরের দশক থেকে পাহাড় কাটার প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তী দশকে তা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছায়। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বন্দর দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠলে নগরে মানুষের চাপ বাড়ে। ফলে পাহাড়-টিলা কাটার প্রবণতাও বাড়ে।
১৯৯০ সালে ১৫৬ বর্গকিলোমিটারের চট্টগ্রামে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ২৩ লাখ। সিটি করপোরেশনের হিসাবে একই আয়তনের চট্টগ্রাম নগরে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ।
গবেষকেরা জানান, পাহাড় ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন প্লেটকে দৃঢ়ভাবে আটকে ধরে রাখে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে পাহাড় ভূপৃষ্ঠের ওপরের স্তরে ভূকম্পন প্রতিরোধ করে। পাহাড় বিলীন হলে বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল হারানোসহ নানা পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটির সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার যেমন সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি অনেক প্রাণিকুলেরও এটি আশ্রয়স্থল। পাহাড় কাটা হলে এর প্রভাবে জীববৈচিত্র্য হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়, খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হয়। এ ছাড়া পাহাড় কাটার কারণে সবুজের আচ্ছাদন কমে যাওয়া, খাল-নালা ভরাট হওয়া, গরম বেড়ে যাওয়াসহ নানা সংকট তৈরি হচ্ছে। পাহাড়-টিলাগুলো সংরক্ষণে পৃথক জরিপ করার পরামর্শ দেন তিনি।