চট্টগ্রামের লালখান বাজার ও সিআরবির মাঝামাঝি রেলওয়ের পাহাড়ের ওপর স্থাপিত হাতির মুখের আকৃতির এই ভবনটি নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। ভবনটি দেখতে প্রতিদিনই আসেন দর্শনার্থীরা। সম্প্রতি তোলা
চট্টগ্রামের লালখান বাজার ও সিআরবির মাঝামাঝি রেলওয়ের পাহাড়ের ওপর স্থাপিত হাতির মুখের আকৃতির এই ভবনটি নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। ভবনটি দেখতে প্রতিদিনই আসেন দর্শনার্থীরা। সম্প্রতি তোলা

চট্টগ্রামের রেলওয়ের ‘হাতির বাংলো’ নিয়ে কেন এত মাতামাতি

পাহাড়ি এলাকায় পিচঢালা সড়কের পাশে খোলা প্রাঙ্গণ। তা পেরিয়ে হাতির বাংলো। হাতির বাংলোর প্রবেশফটকে রয়েছে হাতির মুখ, শুঁড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে। শুঁড় যেমন ঢেউয়ের মতো, ঠিক তেমনই ডুপ্লেক্স বাড়ির ওপরের অংশটিও। এর খোলা অংশটি দোতলার ব্যালকনি। দেশের স্থাপত্য ইতিহাসে একে ব্যতিক্রম বলে মনে করেন স্থপতিরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে চট্টগ্রামের ‘হাতির বাংলো’–এর কথা এখন সারা দেশের মানুষ কমবেশি জানেন। ইউটিউবে ‘হাতির বাংলো’ লিখে সার্চ দিলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। ভ্রমণবিষয়ক ভ্লগার আর কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের কাছে এটি এখন রীতিমতো ট্রেন্ড। এর মধ্যেই ভবনটি যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থানের তালিকায়। কিন্তু শতবর্ষী এই স্থাপনা নিয়ে এত মাতামাতির কারণ কী? এর উত্তর পাওয়া গেল হাতির বাংলোর সম্মুখ দর্শনের পর।

চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট কলোনির বিপরীতে রেলওয়ের ছোট টিলা ধরে উঠতেই চোখে পড়ল ভবনটি। কাউকে চিনিয়ে দিতে হলো না। একটা আস্ত হাতির মাথা যেন কেউ বসিয়ে দিয়েছেন। বোঝা গেল লোকমুখে এমন নামকরণের কারণও। এমন একটি ভবন নিয়ে মাতামাতি না হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক।

যাঁরা জে আর আর টলকিয়েনের ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই হবিটদের কথা মনে আছে। খর্বকায় হবিটদের বাড়ির মতোই অনেকটা রূপকথার আদল আছে এতে। আর পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে এশিয়ান হাতির আকৃতি। রূপকথার আবেশে মিশেছে প্রকৃতির মূর্ত প্রতিকৃতি। সব মিলিয়ে ভবনটি অনন্য। ডুপ্লেক্স এই বাড়ি নিয়ে মানুষের কৌতূহল দীর্ঘদিনের। প্রতিদিনই বাংলোটি দেখতে আসেন অনেকেই। ছবি ও ভিডিও তুলে রাখেন। আবার কেউ কেউ ফেসবুক, ইউটিউবে তা ছড়িয়েও দেন। এভাবে হাতির বাংলো নিয়ে আগ্রহ ও কৌতূহল বেড়ে চলেছে।

চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার আর সিআরবির মাঝের পাহাড়ে অবস্থিত রেলওয়ের হাতির বাংলো। যেতে হয় নগরের শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ সড়কের পাশে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ও লেডিস ক্লাবের সামনের রাস্তা দিয়ে।

এই বাংলো ঠিক কবে নির্মিত হয়েছিল, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই রেলওয়ের কাছে। তবে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৮৯৮ সালের দিকে এই বাংলো নির্মাণ করা হতে পারে। ওই সময় চট্টগ্রামে রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। তখন নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের থাকার জন্য এই বাংলো নির্মাণ করা হতে পারে।

ব্যতিক্রমী স্থাপত্য

এখন যেমন পাহাড় কেটে, গাছপাল কেটে ভবন নির্মাণ করা হয়, হাতির বাংলো নির্মাণে তার কিছুই হয়নি। চারপাশের সৌন্দর্যকে এতটুকুও ব্যাহত করা হয়নি, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে এই স্থাপনা।

পাহাড়ি এলাকায় পিচঢালা সড়কের পাশে খোলা প্রাঙ্গণ। তা পেরিয়ে হাতির বাংলো। হাতির বাংলোর প্রবেশফটকে রয়েছে হাতির মুখ, শুঁড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে। শুঁড় যেমন ঢেউয়ের মতো, ঠিক তেমনই ডুপ্লেক্স বাড়ির ওপরের অংশটিও। এর খোলা অংশটি দোতলার ব্যালকনি। এরপর রয়েছে বড় একটি কক্ষ, যা প্রায় হলরুমের সমান। কেউ থাকেন না এই কক্ষে। সামনে, পেছনে ও পাশে ছোট-বড় আটটি জানালা রয়েছে। বাংলোর নিচতলায় দুটি আলাদা বড় কক্ষ।

বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের ডেপুটি চেয়ারম্যান আদর ইউসুফ জানান, বাংলোটি নির্মিত হয়েছে হাতির আদলে, যা দেশের স্থাপত্য ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। বাহ্যিক কাঠামোটি ত্রিমাত্রিকভাবে হাতির মতোই—মাথা, শুঁড়, কানের পরিণত অংশ, শরীরের বর্ধিত কায়া ইত্যাদি রূপে গঠিত। ভবনটির মূল কাঠামো নির্মিত হয়েছে ইট ও পাথরের গাঁথুনির ওপর। তবে এর হাতির রূপ ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহৃত হয়েছে ফেরো সিমেন্ট, যা উনিশ শতকে উন্নত নির্মাণপ্রযুক্তির নির্দেশক। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কাঠ ব্যবহার করে নির্মিত দরজা ও জানালাগুলোতে কারিগরি দক্ষতার পরিচয় রয়েছে। প্রচলিত ঔপনিবেশিক বাংলোর গঠন থেকে এটি অনেকটাই আলাদা। স্থাপত্যশৈলীতে কোনো সুপরিকল্পিত আদর্শ অনুসরণ না করলেও একে ঘিরে আছে একধরনের আভিজাত্য ও প্রকৌশলগত সৃজনশীলতা।

এক সময় ডুপ্লেক্স এই ভবনটিতে থাকতেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তবে ভবনটি এখন পরিত্যক্ত। সস্প্রতি তোলা

অভিজাত ভবনের এখন ভগ্নদশা

চারপাশে পাহাড়ি এলাকা। সারি সারি নানা প্রজাতির গাছগাছালি। সব সময় নীরব-নিস্তব্ধতা। পাখির কিচিরমিচির শব্দ প্রাঙ্গণজুড়ে। নগরজীবনের যে নাগরিক কোলাহল, তা এখানে অনুপস্থিত।

এমন শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশে নির্মাণ করা হাতির বাংলোতে একসময় থাকতেন রেলের পদস্থ কর্মকর্তারা। তবে কালের বিবর্তনে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় স্থাপত্যের এই বাড়ি এখন প্রায় পরিত্যক্ত। ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে কোনো রকমে। একসময় যেখানে রেলের পদস্থ কর্মকর্তারা থাকতেন, বর্তমানে সেখানে তাঁদের কেউ থাকেন না। বাংলোর জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে বিমুখ হয়েছেন তাঁরা।

একসময়ের জৌলুশে ভরা এই বাংলো বাড়ি এখন পুরোটাই মলিন ও বিবর্ণ। পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছে। ভবনের গায়ে জন্মেছে নানা ধরনের আগাছা।

কর্মকর্তারা যাওয়ার পর বাংলোর নিচতলায় দুটি আলাদা বড় কক্ষের একটিতে থাকতেন হাতির বাংলোর তত্ত্বাবধায়ক জাকের হোসেন। অন্যটিতে জাকের হোসেনের বন্ধু দোকানি মো. মিজান। সম্প্রতি তাঁরাও এই বাংলো ছেড়ে দিয়েছেন।

১৯৯৪ সাল থেকে হাতির বাংলোর তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করে আসছেন জাকের হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বাংলো কবে নির্মিত হয়েছিল, ঠিক জানি না। তবে স্যারদের কাছে শুনেছি, চট্টগ্রাম-ফেনী রেললাইন করার সময় প্রকৌশলীদের থাকার জন্য এখানে হাতির বাংলো নির্মাণ করা হয়।’

জাকের হোসেন বলেন, হাতির বাংলোটি অফিসার্স মেস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রেলওয়ের বিসিএস ক্যাডার ও কর্মকর্তারা এখানে থাকতেন। তাঁর দায়িত্বপালনের সময় একসঙ্গে ৮ থেকে ১০ জন কর্মকর্তাকে এই বাংলোতে থাকতে দেখেছেন। তবে ধীরে ধীরে হাতির বাংলোতে থাকার প্রতি কর্মকর্তাদের আকর্ষণ কমে যায়। কেননা রেলওয়ে নতুন ভবন করেছে, সেখানেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন কর্মকর্তারা। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ পর্যন্ত জাহেদ হোসেন নামের এক কর্মকর্তা থাকতেন। পরে তাঁকে ঢাকায় বদলি করা হলে আর কোনো কর্মকর্তা এখানে আসেননি।

এর পর থেকে তিনি থাকতেন বলে জানিয়ে জাকের হোসেন বলেন, নির্জন এলাকা, নেশাখোরদের দাপট, সাপের ভয়সহ নানা কারণে এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন। তবে নিরাপত্তা ও ভয়ের কারণে ১০-১৫ দিন আগে তিনি ও তাঁর বন্ধু বাংলো ছেড়ে অন্য জায়গায় বাসা নিয়েছেন।

স্থাপত্যের দিক দিয়ে অনন্য এই ভবন সংরক্ষণের দাবি উঠেছে। বাংলোটির ভেতরের একটি কক্ষ। সস্প্রতি তোলা

জাকের হোসেনের বন্ধু মো. মিজান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে থাকার মতো পরিবেশ নেই। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এই বাড়ি। বৃষ্টি হলে পাঁচ-সাত জায়গা দিয়ে পানি পড়ে। সাপের ভয় আছে। জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ঝড়-তুফান হলে তখন ভয় আরও বাড়ে। কখন কোন দিক দিয়ে ভেঙে পড়ে, তার দুশ্চিন্তায় থাকেন। এসব আর নেওয়া যাচ্ছিল না। তাই এই বাংলো ছেড়ে অন্য জায়গায় বাসা নিয়েছেন।

ভবনটির অবস্থা খুবই নাজুক বলে জানান রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ এম রিয়াসাদ ইসলাম। তিনি বলেন, হাতির বাংলোটি কবে নির্মিত হয়েছিল, তার সঠিক কোনো তথ্য–উপাত্ত এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছেন না। তবে চট্টগ্রামে যখন রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল, তখন এই বাংলো নির্মাণ করা হয়েছিল বলে জেনেছেন। শত বছরের পুরোনো এই বাংলোর অবস্থা এখন খুবই খারাপ। এটি ঠিক করতে অনেক অর্থ ব্যয় হবে। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা পাননি। নির্দেশনা পেলে তখন উদ্যোগ নেবেন।

রেল ইতিহাসের স্মারক, সংরক্ষণের তাগিদ

বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের ডেপুটি চেয়ারম্যান স্থপতি আদর ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম শহরের বুকে অবস্থিত শতবর্ষ পুরোনো একটি স্থাপত্য হলো রেলওয়ের হাতির বাংলো। দেখতে অবিকল হাতির মতো, এই ভবন স্থাপত্যরীতি, প্রকৌশল চমৎকারিত্ব ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের এক অনন্য মিশ্রণ। প্রাচীন এই বাংলো নির্মাণের পেছনে রয়েছে ঔপনিবেশিক রেল ইতিহাস, যা আজ বিস্মৃতপ্রায়। এটি কেবল একটি স্থাপনা নয়, বরং ইতিহাস, জীবনধারা এবং সময়কে ধারণ করা একটি ‘স্থায়ী স্মারক’। আজ যখন বাংলাদেশের বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা হারিয়ে যেতে বসেছে, তখন এই বাংলো সংরক্ষণের তাগিদ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলোটি যেন এক ধূসর ইতিহাসের প্রাণবন্ত স্মৃতি। এটি সংরক্ষণ করা মানে একটি সময়, একটি দৃষ্টিভঙ্গি ও একটি চেতনা বাঁচিয়ে রাখা।