
শহরের প্রধান সড়কটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে। সে সড়ক দিয়ে একের পর এক ছুটে যাচ্ছে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, রিকশা, বাস, ট্রাকসহ নানা যানবাহন। এসব বাহনের কর্কশ হর্ন আর টুংটাং শব্দের মধ্যেও পথচারীদের কানে এসে বাজছে বাঁশির মধুর সুর।
ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বড় মাঠের উত্তর ফটকের গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বাঁশির সুর তুলছিলেন ভবেশ রায়। কাছে যেতেই থেমে গেল সুর। বললেন, ‘কারও মধ্যে বাঁশি কেনার কোনো আগ্রহ নাই। তাই আমার মনেও শান্তি নাই। মনে শান্তি না থাকলে বাঁশির সুর কি বের হয়?’
ভবেশ রায়ের বয়স ৭০ পেরিয়েছে। বাড়ি দিনাজপুরের ভূষিরবন্দর এলাকায়। ৫০ বছর ধরে ফেরি করে বাঁশি বিক্রি করছেন তিনি। বাঁশি নিয়ে সপ্তাহখানেক পরপর ঠাকুরগাঁওয়ে আসেন। শহর, গ্রাম, রেলস্টেশন আর পথে-প্রান্তরে ঘুরে সুর তুলে বিক্রি করেন বাঁশের বাঁশি। আকারভেদে প্রতিটি বাঁশি বিক্রি করেন ২০ থেকে ৮০ টাকায়। কীভাবে বাঁশি বাজাতে হয়, তা ক্রেতাকে সেটিও শিখিয়ে দেন তিনি।
ভবেশ বলেন, সারা বছরই বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বাঁশি বিক্রি করেন তিনি। সংগ্রহ করে আনা বাঁশ কেটে বাঁশি তৈরি করতে সহায়তা করেন তাঁর স্ত্রী সলেকা রানী। সেই বাঁশি সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। ১৭ বছর বয়সে গুরু কমল কান্তি রায়ের হাত ধরে তাঁর বাঁশি বাজানো শেখা। সেই থেকে সুরও আয়ত্ত করেছেন কয়েক হাজার গানের। পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, লালনগীতি, বিচ্ছেদ, পুরোনো বাংলা ও হিন্দি সিনেমার গানের সুরও তুলতে পারেন তিনি।
রোজগার কেমন জানতে চাইলে ভবেশের উত্তর, এখন আর খুব একটা রোজগার নেই। বাজারে এখন সব জিনিসের দাম অনেক বেশি। যে মোটা চাল কয়েক দিন আগেও ৪০ টাকা কেজি দরে কিনেছেন, সেই চাল এখন ৫০ টাকারও বেশি। ডাল কিনতে গেলে তেল কেনার টাকা থাকে না, তেল কিনতে গেলে লবণ কেনা হয় না। গাড়ির ভাড়াও অনেক বাড়ছে। মানুষের সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে গেছে। মানুষের মনে সে কারণে আগের মতো শান্তি নেই। আর মনে শান্তি না থাকলে শখের জিনিস কেনার আগ্রহ থাকে কী করে?
করোনার বিধিনিষেধের সময় থেকেই ভবেশের বাঁশি বিক্রিতে ভাটা পড়ে। ভবেশ বললেন, আগে সুর শুনেই কত মানুষ শখ করে বাঁশি কিনে নিয়েছে। আর এখন যতই সুর তোলেন, তেমন কেউ বাঁশি কেনেন না। আগে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকার বাঁশি বিক্রি হতো। আর এখন দিনে ৩০০ টাকাও আয় হয় না। আবার যেটুকু আয় হয়, তার একটা অংশ গাড়িভাড়ার পেছনে চলে যায় বলে জানান ভবেশ। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিনই অভাব বাড়ছে। তারপরও কারও কাছে হাত পাতিনি। আমার চাহিদাও বেশি নাই। বাঁশি বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই জীবন চলে যাচ্ছে।’ বলতে বলতে বাঁশিতে সুর তুললেন, ‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে, দে ছাড়িয়া।’ সুর থামিয়ে তিনি বললেন, ‘এবার তোমরাও হামাক ছাড়ে দাও। অন্য কোনোখানে গিয়ে দেখি বাঁশি বিক্রি করতে পারি কিনা। বাঁশি বিক্রি না হলে যে, আমাদের পেটে ভাত জুটবে না।’
বিকেলের পর বাড়ি ফিরে যান ভবেশ। পরের দিন সকালে বাঁশির ঝোলা কাঁধে নিয়ে আবারও বেরিয়ে পড়েন। বাঁশিতে নতুন নতুন সুর তুলে মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে যান।