চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে শয্যা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। গত বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায়
চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে শয্যা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। গত বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায়

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

মেঝেতে থাকেন সহস্রাধিক রোগী

শয্যাসংখ্যার চেয়ে প্রতিদিন দেড় গুণ রোগী থাকার কারণে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ২ হাজার ২০০টি। তবে গড়ে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকেন সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি।

পেটে গ্যাসজনিত সমস্যা নিয়ে ৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন বেবি আক্তার (৪০)। চিকিৎসক ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলে পাঁচ দিনেও শয্যা পাননি তিনি। ওয়ার্ডের নার্স ও ওয়ার্ড বয়দের অনুরোধ করেও লাভ হয়নি। গত বুধবার সকালেও তাঁকে পাওয়া গেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দায়। মেঝেতে শুয়েই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি।

বেবি আক্তারের ছেলে সাইফুল হক বলেন, পাঁচ দিন ধরে মেঝেতে শুয়েই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। প্রতিদিন সকালে চিকিৎসক আসেন। তবে এরপর আর তেমন কেউ আসেন না। নার্সরা এসে স্যালাইন-ওষুধ দিয়ে চলে যান। তবে মেঝেতে থাকার কারণে সঠিক সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও ওয়ার্ডের ভেতরে শয্যা পাওয়া যায়নি।

এই দৃশ্য শুধু মেডিসিন ওয়ার্ডের নয়; চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি, নিউরোলজি, নেফ্রোলজি, অর্থোপেডিকসহ অধিকাংশ ওয়ার্ডের চিত্রও একই। শয্যাসংখ্যার চেয়ে প্রতিদিন দেড় গুণ রোগী থাকার কারণে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ২ হাজার ২০০টি। তবে গড়ে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকেন সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি।

হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, প্রতিবছর রোগী বাড়ছে। জেলার একমাত্র সরকারি মেডিকেল কলেজ হওয়ায় এখানে রোগীর চাপ বেশি থাকে। হালকা জ্বর কিংবা সর্দিতেও রোগীরা ছুটি আসেন এখানে। প্রায় সময় একটি শয্যার বিপরীতে ২০ জন পর্যন্ত রোগী ভর্তি থাকেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখ রোগী এ হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিয়ে থাকেন। ২০২৪ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছেন ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৮১১ জন। অন্যদিকে জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৩৬ জন এবং ভর্তি ছিলেন ২ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৭।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখ রোগী এ হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিয়ে থাকেন। ২০২৪ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছেন ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৮১১ জন। অন্যদিকে জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৩৬ জন এবং ভর্তি ছিলেন ২ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৭। সক্ষমতার প্রায় দেড় গুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকেন এ হাসপাতালে।

রোগীর চাপ বেড়েছে

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনটি ওয়ার্ড নিয়ে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগ। পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীদের জন্য রয়েছে আলাদা আরেকটি ইউনিট। তিনটি ওয়ার্ড ও এই ইউনিটে অনুমোদিত শয্যা ২৫০-এর কাছাকাছি। এর বাইরে কিছু পুরোনো শয্যাও তিন ওয়ার্ডে আছে। সব মিলিয়ে শয্যা তিন শতাধিক। তবে এখানে রোগী ভর্তি থাকেন দ্বিগুণের বেশি। চিকিৎসকেরা জানান, বিভিন্ন সময়ে রোগীর সংখ্যা ৯০০ পার হয়ে যায়।

মেঝেতে সেবা নেওয়ার কারণে রোগীদের বাড়তি স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কারণে চট্টগ্রামের বাইরে নোয়াখালী, কুমিল্লা থেকেও রোগী এখানে আসেন। সেবা দিতে চিকিৎসকেরা চেষ্টা করছেন। তবে রোগীর চাপ কমাতে শয্যাসংখ্যার পাশাপাশি চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।
—মাহফুজুর রহমান, আহ্বায়ক, জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতি মাসে শয্যা অনুপাতে আবাসিক রোগী ভর্তির হার গড়ে ১৫০ শতাংশ। ২০২২ সালে তা ছিল গড়ে ২০৭ দশমিক ৭ শতাংশ। সে বছর জুনে শয্যাসংখ্যা ১ হাজার ৩১৩ থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২০০টিতে উন্নীত করা হয়। ২০২৫ সালে প্রথম আট মাসে আবাসিক রোগী ভর্তির হার ১৩১ শতাংশ। অর্থাৎ শয্যাসংখ্যা বাড়লেও রোগীর চাপ কমেনি। প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকেন ৩ হাজার ৫০০।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, শুধু চক্ষু ও দন্ত বিভাগ ছাড়া অন্য সব ওয়ার্ডের রোগীর চাপ বেশি থাকে। যেসব ওয়ার্ডে ২৪ ঘণ্টা রোগী ভর্তি করা হয় সেখানে চাপ আরও বেশি। সরেজমিনে হাসপাতালের অন্তত ছয়টি ওয়ার্ড ঘুরে রোগীদের মেঝেতে সেবা নিতে দেখা গেছে। এর মধ্যে মেডিসিন ওয়ার্ডের বারান্দায়, অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের মুখে ও নিউরোলজি ওয়ার্ডের মুখেও মেঝেতে রোগী রাখা হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য ওয়ার্ডে রোগীর চেয়ে স্বজনের সংখ্যা বেশি।

হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগে মোট অনুমোদিত শয্যা ৪৫টি। সব মিলিয়ে শয্যা ৮০টি । তবে এখানে গড়ে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকেন ১২০ জন। এই ওয়ার্ডে মূলত স্ট্রোকের রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। স্ট্রোকে আক্রান্ত অন্য রোগীদের সেবা নিতে হয় মেঝেতে শুয়ে। যেখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধা দিতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসক ও নার্সদের।

জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মেঝেতে সেবা নেওয়ার কারণে রোগীদের বাড়তি স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কারণে চট্টগ্রামের বাইরে নোয়াখালী, কুমিল্লা থেকেও রোগী এখানে আসেন। সেবা দিতে চিকিৎসকেরা চেষ্টা করছেন। তবে রোগীর চাপ কমাতে শয্যাসংখ্যার পাশাপাশি চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

নতুন হাসপাতালের উদ্যোগ

চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলার রোগীদের চিকিৎসাসেবার জন্য এ হাসপাতালের ওপর নির্ভরতা বিগত বছরগুলোতে বেড়েছে। রোগীর চাপ কমাতে হাসপাতালে ১৫০ শয্যার বার্ন ইনস্টিটিউট ও ৪৫০ শয্যার ক্যানসার, কিডনি ও কার্ডিয়াক হাসপাতাল নির্মাণের কাজ চলছে। তবে এর বাইরে ১ হাজার ৫০০ শয্যার আরেকটি হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইউনিট-২ হিসেবে এটি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পরিকল্পনা পাঠানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রামসহ আশপাশে বিভিন্ন জেলা এবং পার্বত্য অঞ্চলের রোগীরা এখানে সেবা নিতে আসেন। ফলে রোগীর চাপ বাড়ছে। আমরা ইউনিট-২ হিসেবে আরেকটি হাসপাতালের পরিকল্পনা নিয়েছি। কলেজের পুরোনো প্রশাসনিক ভবনের স্থানে এটি নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে।’