ক্রেনের সহায়তায় জাহাজে গম বোঝাই করা হচ্ছে
ক্রেনের সহায়তায় জাহাজে গম বোঝাই করা হচ্ছে

গম চুক্তি

বাংলাদেশে গম কোন দেশ থেকে আসে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কতটুকু

বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের গম রপ্তানিকারক সমিতির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে। এর আওতায় আগামী পাঁচ বছরে প্রতিযোগিতামূলক দামে ৭ লাখ টন উচ্চ আমিষযুক্ত গম আমদানি করবে সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশে আমদানিকৃত গমের ৬৪ শতাংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে, যা চলমান যুদ্ধের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগে অনিয়মিতভাবে গম এলেও এবার নিয়মিত আমদানির পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারিভাবে গম আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রোববার যুক্তরাষ্ট্রের গম রপ্তানিকারক সমিতি বা ইউএস হুইট সমিতির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে সরকার। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের কারণে বাণিজ্যঘাটতি কমাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এই উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে কোন কোন দেশ থেকে গম আমদানি হয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির পরিমাণ কেমন, এসব বিষয় সামনে এসেছে।

প্রধান দুই খাদ্যশস্যের মধ্যে গম মূলত আমদানিনির্ভর। উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়। বিশ্ববাজারে দুই ধরনের গম পাওয়া যায়। একটি হলো সাধারণ আমিষযুক্ত, যা বিশ্ববাজারে দাম কম থাকে। আরেকটি হলো উচ্চ আমিষযুক্ত, যা তুলনামূলক দাম বেশি থাকে। বাংলাদেশে সাধারণ আমিষযুক্ত সস্তা গমই আমদানি হচ্ছে বেশি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, গত বছর সরকারি–বেসরকারি খাতে ১৬৩ কোটি ডলার ব্যয়ে (শুল্কায়নমূল্য ২২ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা) ৫৯ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এই গম আমদানি হয়েছে বিশ্বের আটটি দেশ থেকে।

এনবিআরের এক দশকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সাধারণ আমিষযুক্ত সস্তা গম আমদানির বড় উৎস রাশিয়া–ইউক্রেন থেকে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এরপরও গেল অর্থবছরে গম আমদানির ৪৬ শতাংশ বা ২৭ লাখ টন আমদানি হয় রাশিয়া থেকে। ইউক্রেন থেকে আমদানি হয়েছে ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ মোট গম আমদানির ৬৪ শতাংশ আসছে দেশ দুটি থেকে।

যুক্তরাষ্ট্রে গম রপ্তানিকারক সমিতির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির আওতায় আগামী পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে ৭ লাখ টন উচ্চমানের গম আমদানি করবে সরকার। উচ্চ আমিষযুক্ত এই গম বিতরণ হবে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে। এর মানে হলো, গরিব মানুষেরা সামনে উচ্চ আমিষযুক্ত গম হাতের নাগালে পাবে।

এ ছাড়া কানাডা থেকে ১৯ শতাংশ, আর্জেন্টিনা থেকে ৮ শতাংশ, বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া থেকে ৩ শতাংশ করে, ব্রাজিল থেকে ২ শতাংশ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ১ শতাংশ আমদানি হয়।

বাংলাদেশে আমদানি হওয়া গমের প্রায় ৭০ শতাংশই সাধারণ আমিষযুক্ত। এই ধরনের গমের দাম তুলনামূলক কম থাকে। সাধারণ আমিষযুক্ত গম আসছে রাশিয়া–ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও ব্রাজিল থেকে। এসব দেশ থেকে আমদানি হওয়া প্রতি টন গমের দাম পড়েছে ২৬৪ থেকে ২৭৫ ডলারের মধ্যে। সাধারণ আমিষযুক্ত গম দিয়ে রুটি ও সাধারণ মানের বেকারি পণ্য তৈরি হয়।

উচ্চ আমিষযুক্ত গম আমদানি হয়েছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। টনপ্রতি দাম পড়ছে ৩০০ থেকে ৩১৩ ডলার। আর্জেন্টিনা থেকে সাধারণ ও উচ্চ আমিষযুক্ত, দুই ধরনের গম আমদানি হচ্ছে। উচ্চ আমিষযুক্ত গম দিয়ে পরোটা ও উন্নত মানের বিস্কুটসহ নানা খাদ্যপণ্য তৈরি হয়।

গেল অর্থবছরে গম আমদানির তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের নাম ছিল না। দেশটি থেকে নিয়মিত আমদানি না হলেও অনিয়মিতভাবে গম আমদানি হচ্ছে। গত ২২ বছরের মধ্যে ১৫ বছরে দেশটি থেকে সোয়া ২২ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ১৭ লাখ টনের বেশি আমদানি হয়। সরকারি খাতে তিন লাখ টন আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্য সহায়তা হিসেবে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, কেয়ার বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রায় দুই লাখ টন গম এনেছে দেশটি থেকে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই দশকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ গম আমদানি হয়েছে ২০১৯–২০ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে দেশটি থেকে সাড়ে চার লাখ টন গম আমদানি হয়। বেসরকারি সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, নাবিল গ্রুপসহ কয়েকটি গ্রুপ এই গম আমদানি করে। প্রতিযোগিতামূলক দাম পাওয়ার কারণে দেশটি থেকে উচ্চ আমিষযুক্ত গম আমদানি হয়েছিল বলে সে সময়ের একজন আমদানিকারক প্রথম আলোকে জানান।

‘তুলনামূলক দাম কিছুটা বেশি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের গমের মান ভালো। প্রতিযোগিতামূলক দাম ও সুবিধা পেলে দেশটি থেকে বেসরকারি খাতেও গম আমদানি বাড়তে পারে।’
—আমিরুল হক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ

ব্যবসায়ীরা জানান, দেশটি থেকে উচ্চ আমিষযুক্ত গম আমদানি হয়, যা বাংলাদেশে গমের চাহিদার কমবেশি ৩০ শতাংশ। দাম তুলনামূলক বেশি পড়ায় দেশটি থেকে গম আমদানি হয় কম। তবে এখন সরকার দেশটি থেকে আমদানির উদ্যোগ নেওয়ায় গম আমদানিতে দেশটির অংশীদারি বাড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রে গম রপ্তানিকারক সমিতির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির আওতায় আগামী পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে ৭ লাখ টন উচ্চমানের গম আমদানি করবে সরকার। উচ্চ আমিষযুক্ত এই গম বিতরণ হবে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে। এর মানে হলো, গরিব মানুষেরা সামনে উচ্চ আমিষযুক্ত গম হাতের নাগালে পাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম ৭ ডলার কমে ২৩৩ ডলারে বিক্রি হয়েছে। এই দাম কানাডার গমের চেয়ে টনপ্রতি ৫২ ডলার কম। কানাডার গমের দাম ছিল টনপ্রতি ২৮৫ ডলার। অস্ট্রেলিয়ার গমের দাম ছিল টনপ্রতি ২৬২ ডলার।

সামাজিক কর্মসূচিতে বিতরণের জন্য সরকার গত অর্থবছরে রাশিয়া, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, আর্জেন্টিনা থেকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ডলারে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন গম আমদানি করেছে। এই গম কেনা হয়েছে টনপ্রতি ২৮০ থেকে ৩০১ ডলার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিতে কিছুটা খরচ বাড়তে পারে।

গতকাল চুক্তি শেষে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এ সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আস্থা এবং পারস্পরিক বাণিজ্য সহযোগিতার আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি হবে। উভয় দেশের জনগণ এতে উপকৃত হবে।

জানতে চাইলে ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্যঘাটতি কমাতে হলে বেসরকারি খাতে আমদানি বাড়ানোর বিকল্প নেই। তুলনামূলক দাম কিছুটা বেশি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের গমের মান ভালো। প্রতিযোগিতামূলক দাম ও সুবিধা পেলে দেশটি থেকে বেসরকারি খাতেও গম আমদানি বাড়তে পারে।

আমিরুল হক বলেন, গমের পাশাপাশি তুলা, এলপিজি, সয়াবিন ও ইস্পাত কারখানার কাঁচামাল স্ক্র্যাপ (লোহার টুকরো) এই চার পণ্যে চার বিলিয়ন ডলার আমদানির সুযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ জন্য সরকারের লজিস্টিকস খাতে নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে।