
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সবুজ চা-বাগানের ভেতর ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ছড়া থেকে প্রতিদিন রাতের আঁধারে অবৈধভাবে মূল্যবান সিলিকা বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা একাধিক সিন্ডিকেট এই প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে নিচ্ছে।
চুনারুঘাটের বিভিন্ন চা-বাগানের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা ছোট ছড়াগুলো প্রকৃতির প্রাণধারা। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ জলের এ ছড়া চারপাশে সবুজে ঘেরা টিলার প্রাকৃতিক দৃশ্য চা-বাগানের মূল সৌন্দর্য। এ জলের ধারাগুলো টিকিয়ে রেখেছে সেখানকার জীববৈচিত্র্যকে। এখন সেই সৌন্দর্য আর জীববৈচিত্র্য বালু উত্তোলন ও নির্বিচার মাটি কেটে নেওয়ার কারণে ধ্বংস হচ্ছে।
সিলিকা বালু মূল্যবান কারণ এর রাসায়নিক ও ভৌত বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন শিল্পে এর ব্যবহারের জন্য এটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে; যেমন কাচ তৈরি, নির্মাণ সামগ্রী, এবং কৃত্রিম ঘাস।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চা-বাগানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো থেকে দীর্ঘদিন ধরে সিলিকা বালু উত্তোলন করছে কয়েকটি প্রভাবশালী চক্র। তারা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় এ কাজগুলো করছে। তাদের অবৈধ এই কর্মকাণ্ডে ছড়ার প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তলদেশ গভীর হয়ে পড়ছে আর ভেঙে যাচ্ছে দুই তীর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশপাশের বৃক্ষরাজি ও বসতবাড়ি।
গত শনিবার সকালে উপজেলার দেউন্দি চা-বাগানের পাশের গিলানী ছড়ায় গিয়ে দেখা যায়, একদল শ্রমিক বেলচা দিয়ে বালু উত্তোলন করে একটি ট্রাক্টরে ওঠাচ্ছেন। কয়েকজন নারী শ্রমিকও এ কাজে জড়িত। গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতি আঁচ করতে পেরেই দৌড়ে পালিয়ে যান বালু উত্তোলনের কাজে থাকা শ্রমিকেরা। এ সময় ট্রাক্টরচালকও দ্রুতগতিতে স্থান ছাড়েন। চারপাশ ঘুরে দেখা গেছে, ছোট ছড়াটি এখন বিশাল খাদে পরিণত হয়েছে। যেনতেনভাবে বালু উত্তোলন করায় এর আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বিশেষ করে উঁচু–নিচু টিলা ভেঙে ছড়ার মধ্যে গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে ছড়ার প্রশস্ততা বাড়ছে।
এ সময় কথা হয় বলরাম নামের এক বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি বলেন, দিনে যেমন-তেমন, রাত হলেই এ এলাকায় বালু ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। ভয়ে কারও কথা বলার সাহস নেই এই বালু চোরদের বিরুদ্ধে।
গিলানী ছড়ার মতো একইভাবে উপজেলার আরও ১৫ থেকে ২০টি স্থানে সিলিকা বালু উত্তোলন করছে বেশ কয়েকটি চক্র। এর মধ্যে আছে পাইকপাড়া ইউনিয়নের বদরগাজী ও আমপারা ছড়া। এখানে এ বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত আছেন জসিম মিয়া নামের এক ব্যক্তি এবং তাঁর ভাগনে সাবেক ইউপি সদস্য রমজান আলী।
আহমেদাবাদ ইউনিয়নের নালুয়া ও আমু চা–বাগান দিয়ে বয়ে যাওয়া সুতাং ছড়ার কালিশিরী, ঘনশ্যামপুর থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এখানে বালু উত্তোলন করছেন সাব্বির আহমেদ চৌধুরী ও রুমেল আহমেদ নামের আরও দুই ব্যক্তি। গাজীপুর ইউনিয়নের ইসালিয়া সেতুসংলগ্ন স্থান থেকে বালু উত্তোলন করছেন শাকিল আহমেদ, তপু মাস্টার ও কাজল মিয়া নামের তিন ব্যক্তি। মিরাশী ইউনিয়নের বড়জুষ বাজারের জনকুরা এলাকার করাঙ্গী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন আবুল কালাম ও আখলাছ মিয়া নামের দুই ব্যক্তি। রানীগাঁও ইউনিয়নের পারকুল চা–বাগান জিবধর ছড়া মনিপুর ব্রিজের পাশ থেকে বালু উত্তোলন করছেন মিজানুর রহমান নামের এক ইউপি সদস্য।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বালু উত্তোলনকারীদের অধিকাংশই বিএনপির সমর্থক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন। তবে তাঁদের পদপদবি নেই।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে এ প্রতিবেদক কথা বললে তাঁদের প্রত্যেকেই বালু উত্তোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন।
চা-বাগানের শ্রমিকেরা জানান, আগে এসব ছড়ার পানিই তাঁরা দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতেন। এখন সেই পানি ঘোলা হয়ে গেছে, কোথাও কোথাও শুকিয়ে গেছে। ফলে শ্রমিকদের দূর থেকে পানি আনতে হচ্ছে। বালু তোলার কারণে ছড়ার পাশের টিলাগুলো ভেঙে পড়ায় শ্রমিকদের কয়েকটি বস্তিও ঝুঁকিতে পড়েছে।
গিলানী ছড়া এলাকার চা-শ্রমিক জয়ন্ত কৈরী বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই এ ছড়াগুলোতে মাছ ধরেছি, স্নান করেছি। এখন দেখি কেবল বালু খনন আর মেশিনের আওয়াজ। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, গাছ মরে যাচ্ছে।’
পরিবেশবিদরা বলছেন, এসব ছড়া শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস নয়, এগুলো চা-বাগানের পরিবেশব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বালু উত্তোলনের কারণে মাটি ক্ষয় হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে আর টেকসই বাগান চাষ ব্যাহত হচ্ছে। তাঁরা অবিলম্বে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ চান।
পরিবেশকর্মী তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘এর আগেও আমরা সিলেটের ভোলাগঞ্জে দেখেছি কীভাবে সাদাপাথরের সৌন্দর্য ধ্বংস হয়েছে। চুনারুঘাটের ছড়া ও নদীগুলো থেকেও যদি এভাবে সিলিকা বালু উত্তোলন চলতে থাকে, তবে এখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর অনুমোদন ছাড়া সিলিকা বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আমাদের বড় মূল্য দিতে হবে।’
চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, সিলিকা বালুর মহালগুলো জেলা প্রশাসন থেকে কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আসছে। বালু জব্দ, গাড়ি জব্দ, এমনকি লোকজন আটক করে সাজা ও অর্থ জরিমানা করা হয়েছে। এলাকাটি প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ার কারণে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অপরাধীরা ফাঁকফোকরে এ কাজ করেই যাচ্ছে। তবে এ অপরাধ বন্ধে তাঁরা সব সময় সতর্ক আছেন।