খালপাড়ের বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য ছুটছেন চাষিরা। গত মঙ্গলবার কুড়িয়ানা–ভীমরুলী খালে
খালপাড়ের বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য ছুটছেন চাষিরা। গত মঙ্গলবার কুড়িয়ানা–ভীমরুলী খালে

ভাসমান পেয়ারার হাট

ভীমরুলী-কুড়িয়ানায় জালের মতো ছড়িয়ে থাকা খালে শ্রাবণের ঢেউ

শ্রাবণদিনের মেঘলা আকাশ মানেই গুমোট ভ্যাপসা গরম। ৫ আগস্ট, বাংলা পঞ্জিকার হিসাবে ২১ শ্রাবণ, বর্ষার ভরা যৌবন। সকাল সকাল পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা পৌঁছাতে পৌঁছাতে পাতলা মেঘ ঘন-গাঢ় হতে হতে ভারী হয়ে ওঠে। কুড়িয়ানা বাজারের দক্ষিণ দিকে খালের ধারে ছায়া মেলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল শিরীষগাছ, নিচে নৌকার ঘাট। সেখান থেকে শুরু হয় ছোট ছোট খালে ভ্রমণ। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা এই জলপথে নৌকায় ৪০ মিনিট এগোলেই ঝালকাঠির ভীমরুলী বাজার—যেখানে খালের পানিতে ঢেউয়ের তালে তালে বসে ভাসমান পেয়ারার হাট।

চারপাশের গ্রাম থেকে ছোট ছোট কোষা নৌকার খোলে করে চাষিরা নিয়ে আসেন তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। পাইকাররা এসব কিনে বড় ট্রলারে করে নিয়ে যান—তারপর ট্রাকে তুলে পাঠান দেশের নানা প্রান্তে।

আটঘর-কুড়িয়ানা এলাকা পেয়ারার জন্য ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত। তিন জেলার কয়েকটি এলাকা নিয়ে দেশি জাতের পেয়ারার এই সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে প্রায় দুই শতাব্দী আগে। তবে এখন আর শুধু পেয়ারা চাষে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না কৃষকদের। তাই তাঁরা কৃষিতে এনেছেন বৈচিত্র্য—পেয়ারা ছাড়াও লেবু, আমড়া, মাল্টা, ডাবসহ নানা জাতের সবজি চাষ করে নতুনভাবে পথ খুঁজছেন।

ভ্যাপসা গরমের মধ্যে খালে নৌকা ভেসে চলায় খানিকটা স্বস্তি মেলে। খালের শিরার মতো বিস্তৃত জলে বইছে ভেজা বাতাস—মনে হলো শ্রাবণের নিশ্বাস যেন আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর।

দুই শতাব্দীর পেয়ারা-ঐতিহ্য

বরিশালের বানারীপাড়া, ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত এই বাণিজ্যিক পেয়ারা চাষ। বানারীপাড়ার ১৬টি গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠির ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর ও নেছারাবাদের ২৬ গ্রামে ৬৪৫ হেক্টর জমিতে এখনো চাষ হয় দেশি পেয়ারা। দুই শতাব্দীর পুরোনো এই কৃষি ঐতিহ্য আজ টিকে থাকার লড়াই করছে।

বরিশালের বানারীপাড়া, ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত বাণিজ্যিক পেয়ারা চাষ। গত ১ আগস্ট ঝালকাঠির চাঁপাতলা খালে

চাষিদের তথ্য অনুযায়ী, এখনো এ অঞ্চলে অন্তত ৫০ হাজার কৃষক পেয়ারা আবাদে যুক্ত। কিন্তু প্রতিবছর নানা সংকটে তাঁরা খুব একটা লাভের মুখ দেখছেন না। কোষা নৌকায় বইঠা বেয়ে ভীমরুলীতে আসা চাষি পঙ্কজ ঢালী (৫২) জানালেন, এবার ফলন কম। প্রচণ্ড গরমে অনেক ফুল-মুকুল আর কচি পেয়ারা ঝরে গেছে, পুড়ে গেছে। উৎপাদন কম হওয়ায় পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে। গত বছর যে পেয়ারা ৬০০-৮০০ টাকায় বিক্রি করেছি, এবার তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকায় মণ। দাম আগের বছরের চেয়ে বেশি হলেও উৎপাদন কম হওয়ায় চাষিদের লাভ বাড়েনি, বরং কমেছে। এতে বাড়বে দুর্দশাও।

চাষিরা জানাচ্ছেন, এককভাবে পেয়ারা চাষে টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। তাই পেয়ারার পাশাপাশি তাঁরা চাষ করছেন লেবু, মাল্টা, আমড়া, ডাব ও নানা জাতের সবজি।

দীর্ঘকাল ধরে পেয়ারা চাষের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁদের জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো দৃশ্যমান সহায়তা নেই। তাঁরা বলছেন, কম সুদের ঋণের ব্যবস্থা হলে তাঁরা উপকৃত হতেন। কিন্তু সেই সুযোগ না থাকায় এখন তাঁরা উচ্চ সুদে এনজিও ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তাই যা–ও লাভ হয়, তা ঋণের সুদে চলে যায়।
চাষি অর্জুন মণ্ডলের মতে, ‘পেয়ারা খুব দ্রুত পচে। অথচ এখানে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। দ্রুত পেকে নষ্ট হয়ে যায়। এতে বড় ক্ষতি হয়। যদি পেয়ারা প্রক্রিয়াজাত করার মতো কোনো শিল্প গড়ে উঠত, তাহলে আমরা লাভবান হতে পারতাম।’

খালপাড়ের জীবন ও সংস্কৃতি

কুড়িয়ানা-ভীমরুলীর এই ভাসমান হাট শুধু একটি বাজার নয়, এটি এক জলজ সংস্কৃতি, এক ভ্রমণভাসা স্মৃতি এবং কৃষকের ঘামে ভেজা এক শিকড়ের গল্প—যা বর্ষা এলেই পানির বুকে ভেসে উঠে মূর্ত হয়ে ওঠে কবিতার মতো।

এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে নৌকা শুধু বাহন নয়—জীবনের প্রতিচ্ছবি। গত মঙ্গলবার কুড়িয়ানা–ভীমরুলী খালে

ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশালের কীর্তিপাশা, ভীমরুলী, শতদশকাঠি, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠি, কাঠুরাকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর—এসব গ্রামে যুগ যুগ ধরে পেয়ারা চাষ হয়ে আসছে। এখনকার প্রজন্ম সেই ধারাবাহিকতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

দীর্ঘ খালের দুই পাড়জুড়ে রয়েছে পেয়ারা, আমড়া ও সবজির বাগান। খাল থেকে বাগানে পানি চলাচলের জন্য অসংখ্য পরিখা খনন করা হয়েছে। এসব পরিখা এ অঞ্চলের সৌন্দর্যকে বাড়তি মাত্রা দিয়েছে। চাষিরা ছোট নৌকায় সেই পরিখায় ঢুকে গাছের পরিচর্যা ও পেয়ারা সংগ্রহ করেন। তবে চাষের ধরন এখন বদলাচ্ছে। দ্রুত পেকে যাওয়া ও সংরক্ষণের অভাবে চাষিরা অনেকেই বরই, লেবু, আমড়ার দিকে ঝুঁকছেন। ঐতিহ্যবাহী পেয়ারাবাগান আজ মিশ্র বাগানে রূপ নিচ্ছে।

ভীমরুলীর চাষি জাহিদ মিয়া বলেন, ‘যখন ফুল আসে, তখন বৃষ্টি হয় না, গরমে তা ঝরে পড়ে। ফলে গোটাও ছোট হয়। এতে উৎপাদন কমে যায়। আর খরচ যা, তাতে আয় দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকে পেয়ারা চাষ বন্ধ করে দিয়েছেন, কেউবা বাগান ছোট করে ফেলেছেন। এখন আমড়া, লেবু, মাল্টা, সবজির দিকে ঝুঁকছেন।’

কুড়িয়ানার খালে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে নৌকার হাট। সম্প্রতি পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘরে

এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে নৌকা শুধু বাহন নয়—জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রায় প্রতিটি পরিবারের একটি বা একাধিক কোষা নৌকা রয়েছে। এই নৌকাতেই তাঁরা বাজার করেন, ফসল আনা-নেওয়া করেন, সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দেন। একেকটি কোষায় চারজন পর্যন্ত চলাচল করতে পারেন। বেশির ভাগ কোষায় এক বা দুজন দুই প্রান্তে বসে বইঠা বেয়ে চালান।

খালের ছোট ছোট ঢেউ কেটে যখন দূর থেকে একটি নৌকা এগিয়ে আসে, তখন মনে হয়—এ যেন শিল্পীর আঁকা ক্যানভাস। সেই ক্যানভাসে আছে সংগ্রাম, ঐতিহ্য আর পরিবর্তনের ছাপ।

ভাসমান সৌন্দর্য ও পর্যটন

আটঘর-কুড়িয়ানার প্রকৃতি, শিরার মতো ছড়ানো খাল আর ভাসমান হাটের মোহনীয়তা অনেকে তুলনা করেন ভেনিসের সঙ্গে। বর্ষায় এ অঞ্চলের সৌন্দর্য যেন প্রাণ পায়। সেই সৌন্দর্যের টানে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে যান পর্যটকেরা। নৌকার বইঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর ঝুড়িভরা পেয়ারার সুবাস পর্যটকদের মনে গেঁথে থাকে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হিসেবে।

নৌকায়ে ভেসে ভেসে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা খাল ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেন পর্যটকেরা। গত মঙ্গলবার কুড়িয়ানা–ভীমরুলী খালে

ভীমরুলীতে ৮–১০টি ভাসমান হোটেল, ১০০টির বেশি ট্রলার, ৩০–৩৫টি পর্যটকবাহী নৌকা চলে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র—কঠুরাকাঠিতে ১০ একরের পেয়ারাবাগানে ‘ন্যাচারাল ট্যুরিজম অ্যান্ড পিকনিক স্পট। পাশের আদমকাঠিতে রিয়ান পেয়ারা পার্কসহ আরও একটি বিনোদনকেন্দ্র ঘুরে দেখার সুযোগ আছে।

ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে এসেছিলেন সফিকুল ইসলাম। ছোট নৌকায় ভাসতে ভাসতে এসব দেখে মুগ্ধ সফিকুল বললেন, ‘লোকমুখে এই জায়গার অনেক সুন্দর বর্ণনা শুনেছি। তাই মঙ্গলবার সরকারি ছুটি থাকায় পরিবার নিয়ে চলে এলাম। কিন্তু জায়গাটার সৌন্দর্যের বর্ণনা লোকমুখে যা শুনেছি, বাস্তবে তার চেয়েও সুন্দর। আমরা এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষের সংগ্রাম ও ভিন্নতর সংস্কৃতি দেখে সত্যি মুগ্ধ।’
ভীমরুলী থেকে ফেরার পথে দুপুর গড়িয়ে যায়। এমন সময় আকাশ ভেঙে শুরু হলো শ্রাবণের তুমুল বর্ষণ আর দমকা হাওয়া। মনে হলো, প্রকৃতি যেন নিজেই জেগে উঠেছে এই ভাসমান জীবনের গল্পে আরেকটি স্তবক যোগ করতে।