নোয়াখালীর হাতিয়ার জাগলার চর। আজ সকালে তোলা
নোয়াখালীর হাতিয়ার জাগলার চর। আজ সকালে তোলা

হাতিয়ায় ৫ জন নিহত

চরের জমি বিক্রি করে তিন সন্ত্রাসী বাহিনী, দখল নিয়েই সংঘর্ষ-গোলাগুলি

হাতিয়ার জাগলার চরের দখল নিয়ে তিনটি সন্ত্রাসী বাহিনীর বিবাদ চলে আসছে। জমি দখলে নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে কম মূল্যে বিক্রি করে এসব বাহিনী। গতকাল এসব বাহিনীর সংঘর্ষ–গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হন।

নোয়াখালীর হাতিয়ার যে চরটিতে সংঘর্ষ-গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হয়েছেন, সেটির দখলে রয়েছে স্থানীয় তিনটি সন্ত্রাসী বাহিনী। আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের কাছে কম মূল্যে এসব বাহিনী জমির দখল বিক্রি করে আসছে। গতকাল মঙ্গলবার চরটিতে সংঘর্ষ-গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে এই দখলকে কেন্দ্র করে।

সন্ত্রাসী দল তিনটি ‘কোপা শামছু বাহিনী’ ‘আলাউদ্দিন বাহিনী’ এবং ‘ফরিদ কমান্ডারের বাহিনী’ নামে পরিচিত। এসব বাহিনীর প্রধানসহ সদস্যদের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তবে বিভিন্ন দলের আশ্রয়ে তারা অপকর্ম করে আসছেন বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা।

গতকাল সকালে উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড-সংলগ্ন জাগলার চরের দখল নিয়ে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২৫ থেকে ৩০ বছর আগে হাতিয়ার মূল ভূখণ্ডের পশ্চিম পাশে মেঘনার কোলে চরটি জাগতে শুরু করে। চরটিতে এখন পর্যন্ত মানুষের স্থায়ী কোনো বসতি নেই। তবে মানুষ সেখানে পশুপালন ও চাষাবাদ করে আসছে। এই চরের জমি সরকারিভাবে কাউকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি।

আজ সকালে চরটিতে গিয়ে দেখা যায়, গরু-মহিষ নিয়ে কিছু মানুষ চরটিতে রয়েছেন। এ ছাড়া কৃষি কাজেও ব্যস্ত দেখা যায় কয়েকজনকে। তাঁদের কাছে গতকালের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তবে কারও কাছেই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। জানা গেল, চরে মানুষের স্থায়ী বসতি না থাকলেও প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন শ মানুষ চাষাবাদ ও গরু-মহিষ লালন পালনের জন্য আসেন। যদিও আজ উপস্থিতি ছিল একেবারেই হাতে গোনা।

গতকাল সকালে চরের জমি দখলকে কেন্দ্র করে কোপা শামছু, আলাউদ্দিন ও ফরিদ কমান্ডারের বাহিনীর মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এর একপর্যায়ে ফরিদ বাহিনীর লোকজন পিছু হটে। পরে শামছু ও আলাউদ্দিন বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চরের জমি বাণিজ্যিক উদ্দেশে দখল শুরু হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর। হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের কোপা শামছু বাহিনী প্রথমে জমি দখলে নিয়ে বিক্রি শুরু করেন। পরে সুখচর ইউনিয়নের আলাউদ্দিন বাহিনীও চরে জমির দখল নিয়ে বিক্রি করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে আলাউদ্দিন বাহিনীর লোকজনও জাগলার চরের খাসজমি বিক্রি শুরু করেন। প্রতি একর জমি ২০-২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে আসছিলেন বাহিনীর সদস্যরা। কয়েক মাস আগে এই দুটি বাহিনীর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে দখলে যুক্ত হয় ফরিদ কমান্ডারের বাহিনীর লোকজন। এর পর থেকে তিনটি বাহিনীর মধ্যেই বিবাদ-সংঘর্ষ লেগে আছে। চরের জমি দখলের প্রতিবাদ করে গত ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হামলার শিকার হন জাতীয় নাগরিক পার্টির তিন কর্মী। তাঁরা হলেন-মো. হাছান উদ্দিন, এমদাদ হোসেন ও মো. রাজিব উদ্দিন।

স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, গতকাল সকালে চরের জমি দখলকে কেন্দ্র করে কোপা শামছু, আলাউদ্দিন ও ফরিদ কমান্ডারের বাহিনীর মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এর একপর্যায়ে ফরিদ বাহিনীর লোকজন পিছু হটে। পরে শামছু ও আলাউদ্দিন বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়। এ সময় বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। আলাউদ্দিন বাহিনীর প্রধান আলাউদ্দিনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁর সহযোগীরা জেলা সদরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আরও চারজনের লাশ উদ্ধার করে। তাঁরা হলেন মোবারক হোসেন, আবুল কাশেম, হক মিয়া ও কামাল উদ্দিন।

বাসিন্দারা বলেন, চর দখলের সঙ্গে জড়িত এই তিন বাহিনীর সদস্যরা আগে নিজেদের আওয়ামী লীগের লোক পরিচয় দিতেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তাঁদের কেউ নিজেদের বিএনপি, কেউ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লোক পরিচয় দিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টায় রয়েছেন।

নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি এসব সন্ত্রাসী বাহিনীকে চরে প্রতিষ্ঠিত করছে। আমি বিভিন্ন সমাবেশে এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
আবদুল হান্নান মাসউদ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক, এনসিপি।

চর দখলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিএনপি আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে দাবি করেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনে দলের প্রার্থী আবদুল হান্নান মাসউদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি এসব সন্ত্রাসী বাহিনীকে চরে প্রতিষ্ঠিত করছে। আমি বিভিন্ন সমাবেশে এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।’

তবে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও নোয়াখালী-৬ আসনে দলের প্রার্থী মাহবুবের রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি খুবই জঘন্য। সন্ত্রাসী, ডাকাতের কোনো দল নেই, এরা অপরাধী। তবে কারা এসব সন্ত্রাসী ও বাহিনীকে নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছেন, সেটা সবারই জানা রয়েছে। আমরা আশা করি প্রশাসন তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।’

মামলা হয়নি, আটকও নেই

চর দখল নিয়ে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় আজ বুধবার দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। এ ঘটনায় কাউকে আটকও করতে পারেনি পুলিশ। নিহত ব্যক্তিদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সকালে জেলা সদরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

জানতে চাইলে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আলা উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হলেও আরও একজন নিহত হয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। অপরজনের লাশের খোঁজে নৌবাহিনীর সদস্যরা চরে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছেন। ইউএনও বলেন, ‘নতুন জেগে ওঠা চরটিতে সরকারিভাবে কাউকে ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি।’

কারা এসব সন্ত্রাসী ও বাহিনীকে নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছেন, সেটা সবারই জানা রয়েছে। আমরা আশা করি প্রশাসন তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।
মাহবুবের রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক, বিএনপি।

হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইফুল আলম আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। অভিযোগ পেলে এর আলোকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিহতদের লাশ মর্গে রয়েছে।

উপকূলীয় বন বিভাগের নোয়াখালীর নলচিরা রেঞ্জের কর্মকর্তা আল আমিন গাজী প্রথম আলোকে বলেন, চরটিতে এ পর্যন্ত এক হাজার হেক্টরের মতো জমিতে বনায়ন করা হয়েছে। সর্বশেষ বনায়ন করা হয় ২০২২ সালে। বর্তমানে চরের আয়তন কত, সে বিষয়ে বন বিভাগের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।