
ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি নোয়াদ্দা এলাকার সরু রাস্তায়। সেই স্নিগ্ধ সকালের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসে শিশুদের খিলখিল হাসি। কেউ বই হাতে, কেউ ব্যাগ কাঁধে, কেউ–বা বন্ধুর হাত ধরে ছুটে চলেছে স্কুলের দিকে। তাদের চোখে কৌতূহলের ঝিলিক, যেন কোনো গুপ্তধনের খোঁজে রওনা হয়েছে।
সম্প্রতি এক সকালে রিয়াজ পাবলিক স্কুলে গেলে এমন চিত্র চোখে পড়ে। স্কুলটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জের নোয়াদ্দা এলাকায়। স্কুলটি শুধু ইট-কাঠের ভবন নয়, বরং নতুন আশার প্রতীক। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের শিশুরা মাসে মাত্র ৩০০ টাকায় এখানে উন্নত মানের শিক্ষা পাচ্ছে। সঙ্গে বিনা মূল্যে মিলছে ইউনিফর্ম, জুতা, ব্যাগ, বইপত্র। শিশুদের কাছে এই বিদ্যালয় যেন স্বপ্নের সিঁড়ি।
স্কুল শুরুর যাত্রা
২০২৩ সালের শুরুতে ইপিলিয়ন গ্রুপের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচির অংশ হিসেবে রিয়াজ পাবলিক স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জের নোয়াদ্দা এলাকায় ৫০ শতাংশ জমির ওপর পাঁচতলার আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর স্কুল করা হয়। স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন ইপিলিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন আল মামুন। খোলা মাঠ, চারপাশে গাছগাছালি, আলো-বাতাসে ভরা ক্লাসরুম শিশুদের মনকে মুক্ত করে, বইয়ের বাইরে বিশাল এক জগৎ দেখাতে শেখায়। সব মিলিয়ে একটি প্রাণবন্ত শেখার পরিবেশ।
অ্যাস্ট্রো ক্যাম্পে অংশ নেওয়ার পর থেকে মহাকাশের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে আমি নাসার একজন সফল বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখি। আর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই।জান্নাত নূর, রিয়াজ পাবলিক স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী
বিদ্যালয়টিতে শিশু থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ১৯২ জন শিক্ষার্থী পড়ছে। প্রতিটি ক্লাসে সর্বোচ্চ ২৪ জন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক আছেন ১০ জন। তাদের পড়াশোনা দেখভালের দায়িত্বে আছেন একাডেমিক মেন্টর। পড়াশোনায় সমস্যা থাকলে আলাদা সহায়ক ক্লাসের ব্যবস্থা আছে। মেধাবীরা স্ব-শিক্ষা গ্রুপে একে অপরকে শিক্ষক হয়ে শেখায়। শিক্ষার ধরনও ভিন্নধর্মী।
রিয়াজ পাবলিক স্কুল বাংলাদেশে নাসা অ্যাস্ট্রো ক্যাম্প কমিউনিটি পার্টনারস প্রোগ্রামের (এসিসিপি) অফিশিয়াল সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এই স্কুলের শিক্ষকেরা নাসা এসিসিপি ক্যাম্প পরিচালনা করার জন্য নাসা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
পাঠদানের নতুন ধারণা
এই স্কুলে পড়া মানে শুধু মুখস্থ করা নয়। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রিমা আক্তার বলল, ‘আমরা শুধু বই পড়ি না। “বাচ্চা বিজ্ঞানী ক্লাব”-এ রোবট বানাই, চিত্রাঙ্কন করি, গণিত দিয়ে সমস্যা সমাধান করি। খেলার মতো শেখা হয়।’
পঞ্চম শ্রেণির রাফি হাসান পছন্দ করে ‘মুভি নাইট’। যেখানে সিনেমার দেখার পর গল্পের শিক্ষা আলোচনা করা হয়। এতে পড়াটা মুখস্থ না থেকে গল্পের মতো মনে থাকে, বলল রাফি।
নাসার অ্যাস্ট্রো ক্যাম্পে আমরা শিক্ষার্থীদের একেবারে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি। যারা প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে ভালো করতে পারে না, তারাই এখানে সৃজনশীলতা ও মেধার দারুণ প্রকাশ ঘটিয়েছে।মোহাইমিলুন হোসাইন সানজানী, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কো-অর্ডিনেটর ও সহকারী শিক্ষক, রিয়াজ পাবলিক স্কুল
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাত নূর বলে, ‘অ্যাস্ট্রো ক্যাম্পে অংশ নেওয়ার পর থেকে মহাকাশের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে আমি নাসার একজন সফল বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখি। আর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই।’
বিদ্যালয়ের একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর রাইসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই শিশুরা ভয়ের মধ্যে নয়, আনন্দের সঙ্গে শিখুক। আমাদের লক্ষ্য তাদের বিশ্বমানের নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।’
অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কো-অর্ডিনেটর ও সহকারী শিক্ষক মোহাইমিলুন হোসাইন সানজানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাসার অ্যাস্ট্রো ক্যাম্পে আমরা শিক্ষার্থীদের একেবারে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি। যারা প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে ভালো করতে পারে না, তারাই এখানে সৃজনশীলতা ও মেধার দারুণ প্রকাশ ঘটিয়েছে। বাচ্চাদের যদি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, তারা একদিন অদূর ভবিষ্যতে মহাকাশ জয়ের স্বপ্নও বাস্তবায়ন করতে পারবে।’
অভিভাবকদের আস্থা
বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে শুধু ভালো ফল নয়, জীবনযাপনের দক্ষতা (লাইফ স্কিল) শেখানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। লাইফ স্কিল ওয়ার্কশপে শিক্ষার্থীরা শেখে আবেগ নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ আর সময় ব্যবস্থাপনা। ‘ম্যাথ ম্যাজিশিয়ান ক্লাব’-এ শেখে বাস্তব সমস্যার সমাধানে গণিতের ব্যবহার। অভিভাবকেরাও বিদ্যালয়টির এসব উদ্যোগের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখছেন।
আমাদের লক্ষ্য শুধু স্কুল নয়, পুরো সমাজকে বদলানো। রিয়াজ পাবলিক স্কুল সেই পরিবর্তনের একটি ধাপনাজমুল হাসান, সহকারী মহাব্যবস্থাপক, ইপিলিয়ন গ্রুপ
কুশিয়ারা এলাকার গৃহিণী জাহানারা বেগম বলেন, তাঁদের মতো পরিবারের পক্ষে এত ভালো স্কুলে পড়ানো সম্ভব ছিল না। এই স্কুলে মাসে মাত্র ৩০০ টাকায় ইউনিফর্ম, জুতা, ব্যাগ, বইসহ সব পাওয়া যায়। আরেক অভিভাবক আতাউর রহমান বলেন, ‘স্কুলটিতে অনেক গরিবের সন্তানেরা সামান্য খরচে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা পাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বিশাল পাওয়া।’
জাতীয় সাফল্য ও স্বীকৃতি
শিক্ষায় ব্যতিক্রমী পদ্ধতির কারণে রিয়াজ পাবলিক স্কুল খুব কম সময়েই জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলা সাহিত্য অলিম্পিয়াড, চারুকলার জলছবি প্রতিযোগিতা, গণিত ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে শিক্ষার্থীরা কৃতিত্ব অর্জন করেছে। নাসা অ্যাস্ট্রো ক্যাম্প পার্টনারশিপ প্রোগ্রামে অংশীদার হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্যাম্পে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
এ বিষয়ে ইপিলিয়ন গ্রুপের সিএসআর বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য শুধু স্কুল নয়, পুরো সমাজকে বদলানো। রিয়াজ পাবলিক স্কুল সেই পরিবর্তনের একটি ধাপ।’
ভোরের আলোয় শিশুরা যখন স্কুলের দিকে ছুটে যাচ্ছে, তখন মনে হয় এটি শুধু একটি স্কুল নয়, বরং নতুন ভোর। এখানেই গড়ে উঠছে আগামী দিনের স্বপ্নদ্রষ্টা নাগরিক, যারা আলো-বাতাস ভরা এই বিদ্যালয় থেকে বড় হয়ে পৃথিবীকে বদলানোর কৌশল শিখছে।