কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার অরণ্যপুরে গোমতীর চরের নিচু স্থানে নির্মাণ করা একটি খাবারের দোকানের স্থাপনা ইতিমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার অরণ্যপুরে গোমতীর চরের নিচু স্থানে নির্মাণ করা একটি খাবারের দোকানের স্থাপনা ইতিমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে

আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কেটেছে গোমতীপারের মানুষের, বাঁধে খুপরি বানাচ্ছেন কেউ কেউ

কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার সংরাইশ এলাকা। দুপুরে গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজনের ভিন্ন রকম ব্যস্ততা দেখা গেল। কেউ সড়কের পাশে বেড়িবাঁধের ওপর মাটিতে বাঁশ গাড়ছেন। কেউ আবার সেই বাঁশে পলিথিন বা ত্রিপল দিয়ে খুপরি ঘর বানাচ্ছেন। নদীর পানি বাড়ায় নারী-পুরুষ সবার মধ্যেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব আনোয়ারা বেগম। বেড়িবাঁধের ভেতরে গোমতী নদীর চরে ভাঙাচোরা একটি টিনের ঘরে বসবাস করেন। গোমতী নদীর পানি ঘরের কাছাকাছি চলে আসায় উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। আনোয়ারা বলেন, ‘তিন দিন ধইরা নদীর পানি বাড়তাছে। গত বছর এক রাইতের মইধ্যে আমার সবকিছু ভাসাইয়া লইয়্যা গেছে। তহন কয়েকটা পোলাপাইন আমারে উদ্ধার কইরা একটা স্কুলে নিয়া গেসিল। বন্যা যাওনের পর মাইনষের কাছ থাইক্যা সাহায্য লইয়া ঘরটা ঠিক করছিলাম। এহন আবার হুনতাছি বন্যা আইতাছে। কালকা রাইতে এক মিনিটও ঘুমাইছি না।’

পাশে বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে খুপরি ঘর বানাচ্ছিলেন বাবুল মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের মতোই পানি বাড়তেছে। পানি এখন যে অবস্থায় আছে, আরেকটু বাড়লেই চরের বাসিন্দাদের ঘরে প্রবেশ করবে। এ জন্য বাঁশ আর পলিথিন দিয়ে এটি নির্মাণ করেছি যেন মালপত্র এনে রাখা যায়।’

বৃহস্পতিবার উপজেলার টিক্কারচর, জগন্নাথপুর, সংরাইশ, বানাসুয়া, অরণ্যপুরসহ গোমতী নদীর বিভিন্ন অংশ ঘুরে অন্তত ২০টি স্থানে এমন খুপরি নির্মাণ করতে দেখা গেছে। নদীতে পানি বাড়ায় কেউ কেউ বাড়িঘর ছেড়ে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে মালামাল বেড়িবাঁধে এনে রাখছেন। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, ধীরগতিতে হলেও ইতিমধ্যে গোমতী নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে মানুষকে সচেতন হতে হবে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের আগস্টে গোমতীর ভয়াবহ রূপ দেখেছিলেন কুমিল্লাবাসী। ২২ আগস্ট রাতে জেলার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছিল বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াসহ কয়েকটি উপজেলা। স্মরণকালের সেই বন্যার ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন বাসিন্দারা। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গোমতী নদীর পানি বাড়ছে। যদিও আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে ছিল। এরপরও পানি বাড়তে থাকায় চারদিকে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

গোমতী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে বাঁশ, পলিথিন ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী স্থাপনা। বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার সংরাইশ এলাকায়

কুমিল্লা পাউবো সূত্র জানায়, কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানির বিপৎসীমার স্তর ১১ দশমিক ৩০ মিটার। গতকাল বুধবার বেলা তিনটার দিকে নদীর পানি ৮ দশমিক ৮৩ স্তরে প্রবাহিত হচ্ছিল। সর্বশেষ আজ সকাল নয়টা পর্যন্ত নদীর পানি বেড়ে ৯ দশমিক ৬৮ মিটারে পৌঁছায়। এর পর থেকে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে ধীরগতিতে। আজ সন্ধ্যা ছয়টায় ৯ দশমিক ৪৮ মিটার স্তরে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল, যা বিপৎসীমার প্রায় ৬ ফুট নিচে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি নিচু এলাকায় চরের কৃষিজমি ও স্থাপনা পানিতে তলিয়ে গেছে।

উপজেলার অরণ্যপুর, চানপুর, বানাসুয়াসহ কয়েকটি স্থানে নদীর চরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু খাবারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অরণ্যপুর এলাকার গোমতী বিলাস নামের রেস্তোরাঁর পরিচালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত যে অবস্থা, তাতে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। তবে তাঁরা আতঙ্কে আছেন। যদি পানি বাড়ে তাহলে গত বছরের মতো ক্ষতি হবে।

বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তানভীর হোসেন বলেন, পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। তবু সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। এ ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলায় তাঁদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে।

কুমিল্লা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছৈয়দ আরিফুর রহমান বলেন, কুমিল্লায় বৃষ্টির পরিমাণ কমে এসেছে। আজ বেলা তিনটা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লায় ৭৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে কালও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত জেলার কোথাও বন্যার সৃষ্টি হয়নি। কয়েকটি স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোও তাঁরা প্রায় সমাধান করে ফেলেছেন। আশার কথা হলো গোমতী নদীর পানি ধীরগতিতে হলেও কমে আসছে। আশা করছেন, দু-এক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। এ জন্য মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। দুর্যোগ মোকাবিলায় ইতিমধ্যে ৫৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

গত বছর অতিবৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা উজানের ঢলে ১৮ আগস্ট থেকে হঠাৎ বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে গোমতী নদীর পানি। এর মধ্যে ভারতে গোমতীর ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় ২২ আগস্ট রাতে বুড়িচং উপজেলার বুড়িবুড়িয়া এলাকায় বাঁধ ভেঙে বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় শত শত গ্রাম। ডুবে যায় বেড়িবাঁধের সব বাড়িঘর ও কৃষিজমি।