নিজেদের তৈরি করা খাবার হাতে দুই বোন জয়া চাকমা ও বিজয়া চাকমা। সম্প্রতি তোলা
নিজেদের তৈরি  করা খাবার হাতে দুই বোন জয়া চাকমা ও বিজয়া চাকমা। সম্প্রতি তোলা

চাকরির পর ফুটপাতে পিঠা বানান জয়া-বিজয়া, ভিড় জমে ক্রেতাদের

চট্টগ্রাম নগরের টেকনিক্যাল মোড়ে পাহাড়ি দুই বোন জয়া চাকমা ও বিজয়া চাকমা পরিচালনা করেন একটি ছোট্ট ফুডকোর্ট। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন দুজন। অফিস শেষে ফুডকোর্টটিতে বিক্রি করেন পাহাড়ি পিঠা, চটপটি, মুন্ডিসহ নানা খাবার।

ফুটপাতে ছোট্ট একটি ফুডকোর্ট। সেখানেই চায়ের কেটলি থেকে উঠছে ধোঁয়া। পাশে গরম তাওয়ায় সেঁকা হচ্ছে পাহাড়ি পিঠা। ক্রেতারাও একে একে আসছেন সেই ফুডকোর্টের সামনে। বসে গল্পগুজব করছেন, ফাঁকে এসব পিঠার স্বাদ নিচ্ছেন।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের টেকনিক্যাল মোড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এ দৃশ্যের। এ এলাকায় আরও ১৫টি ফুডকোর্ট রয়েছে। তবে এ ফুডকোর্টটি আলাদা। এটি পরিচালনা করছেন দুই বোন। নাম জয়া চাকমা (২৯) ও বিজয়া চাকমা (২২)। পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায় বলে তাঁরা ফুডকোর্টের নামও দিয়েছেন ‘দ্য হিলস কিচেন’। ছোট্ট এ ফুডকোর্ট ঘিরেই স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা।

জয়া চাকমা পরিবারের বড় মেয়ে। দুই বোনই স্বল্প বেতনে নগরের দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার কামাইছড়া ইউনিয়নে। বাবা সুজন চাকমা পেশায় কৃষক। মা সুজাতা চাকমা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। মূলত দুই বোনের আয়েই চলে সংসারের মূল খরচ।

দুই বোন জানান, দুজনই ভিন্ন দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োজিত। স্বল্প বেতনের সেই চাকরির আয়ে পরিবারের খরচের জোগান দিতে হিমশিম খেতে হতো। তাই তাঁদের ব্যতিক্রম কিছু করার ভাবনা মাথায় আসে। সেই ভাবনা থেকেই ফুডকোর্ট দিয়েছেন। প্রতিদিনই অফিস শেষ করে নিজেদের ফুডকোর্টে পিঠাসহ খাবার বিক্রি করেন।

স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। পরিবার পাশে ছিল বলে উঠে দাঁড়াতে পেরেছি। একদিন বোনের সঙ্গে কথাবার্তার এক ফাঁকে খাবারের দোকানের সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, অফিসের বেতন দিয়ে কিছু হবে না।
জয়া চাকমা

নতুন জীবনের পথে

গত বছরের ডিসেম্বরে ছোট ভাই বিজয়কে নিয়ে চট্টগ্রামে এসেছিলেন জয়া ও বিজয়া। জয়ার ৯ বছর বয়সী কন্যাসন্তান রয়েছে। ২০২২ সালে স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। এর পর থেকে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তিনি।

জয়া চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। পরিবার পাশে ছিল বলে উঠে দাঁড়াতে পেরেছি। একদিন বোনের সঙ্গে কথাবার্তার এক ফাঁকে খাবারের দোকানের সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, অফিসের বেতন দিয়ে কিছু হবে না।’

পিঠাসহ খাবার তৈরিতে ফুডকোর্টে ব্যস্ত দুই বোন। সম্প্রতি তোলা

গত আগস্টে শুরুতে দুই বোন জমানো কিছু টাকা আর এক স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকায় দোকানের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনেন। পরের মাসে দুই হাজার টাকায় একটি ফুডকোর্ট ভাড়া করেন। সেই থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। প্রথমদিকে ক্রেতা কম থাকলেও ধীরে ধীরে তাঁদের বেচাবিক্রি বেড়েছে। ছোট ভাই বিজয় পড়াশোনার পাশাপাশি কেনাকাটা আর দোকানের সরঞ্জাম গুছানোর কাজ করেন। দুই বোন অফিস থেকে এসে বিকেলে ফুডকোর্টে বিক্রি শুরু করেন।

বিজয়া চাকমা বলেন, ‘প্রথম দিন দোকান খুলেই আমরা ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। ওই পোস্ট বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে পড়ে। ভাবিনি এত সাড়া পাব। অনেক অচেনা মানুষ খুঁজে খুঁজে এসেছেন। তাঁরা পিঠা খেয়ে প্রশংসা করার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক কথা বলেছেন।’

ভাবিনি এত সাড়া পাব। অনেক অচেনা মানুষ খুঁজে খুঁজে এসেছেন। তাঁরা পিঠা খেয়ে প্রশংসা করার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক কথা বলেছেন।
বিজয়া চাকমা

পাহাড়ি পিঠা খেতে ভিড়

দুই বোনের ছোট্ট ফুডকোর্টটিতে এখন বিক্রি হয় তিন ধরনের পাহাড়ি পিঠার পাশাপাশি চটপটি, মুন্ডি, ছিটা পিঠা আর চা। সন্ধ্যা নামলেই আশপাশের অফিসের কর্মীদের পাশাপাশি ভিড় জমে কলেজ ও কোচিংয়ের ছাত্রছাত্রীদের।

সম্প্রতি ফুডকোর্টটিতে গিয়ে দেখা হয় নগরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরাফাত রহমানের সঙ্গে। তিনি বন্ধুদের নিয়ে ফুডকোর্টটিতে এসেছেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ দোকানের পিঠাগুলো তৈরি হয় বাড়ির পরিবেশে। এ কারণে স্বাদও থাকেও বেশ। প্রায়ই তিনি বন্ধুদের নিয়ে এখানে আসেন।

জয়া ও বিজয়ার স্বপ্ন অবশ্য ফুডকোর্টে সীমাবদ্ধ নেই। দুজনেরই ইচ্ছা নগরে বড় রেস্তোরাঁ দেওয়া। জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘শুরুটা ছোট, তবে আমাদের ইচ্ছা আমরা রেস্তোরাঁ দেব। ধীরে ধীরে এ খাবারের দোকানটিকে বড় করে তুলব। সংসার আর চাকরি সামলে আপাতত এখানে সময় দিচ্ছি। একসময় পুরোটা সময় রেস্তোরাঁর জন্য দেব।’