জসিম উদ্দিন আহমদ
জসিম উদ্দিন আহমদ

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী ‘আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট’ ব্যবসায়ী জসিম

অবশেষে ফাঁকা আসন চট্টগ্রাম-১৪-তে (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া আংশিক) ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন আহমদকে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় তাঁকে দলের প্রার্থী ঘোষণার পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, জসিমের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য ছিল।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে থাকা জসিম উদ্দিনের বিভিন্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালে মে মাসে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর বাড্ডার একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন তিনি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, চন্দনাইশ আসনে জসিম উদ্দিনকে বিএনপির প্রার্থী করেছে দল। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দলে জসিমের কোনো পদ নেই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জসিমের সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলা ও ৩৪টি থানা এলাকা নিয়ে ১৬টি সংসদীয় আসন। এর মধ্যে নগরের ১৬টি থানা এলাকায় আসন রয়েছে ৪টি। অন্য ১২টি আসনের মধ্যে ৭টি উত্তর চট্টগ্রাম ও ৫টি দক্ষিণ চট্টগ্রামে।

মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ক্ষোভ

মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের নির্ধারিত সময়ের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে চট্টগ্রাম-১৪ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করে বিএনপি। এ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ-বিষয়ক সম্পাদক মহসিন জিল্লুর করিম, ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও সাবেক বিচারপতি আবদুস সালাম মামুন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মিজানুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম চৌধুরী মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এ ছাড়া মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন বিএনপি কর্মী মোহাম্মদ ইখতিয়ার হোসেন, মোহাম্মদ আল হেলাল, এম এ হাশেম, এজাজ আহমদ চৌধুরী, জাকির হোসেন ও সিরাজুল ইসলাম।

জসিমকে দলের প্রার্থী ঘোষণা করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আনোয়ার চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জসিম আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষক। ওই সরকারের আমলের পুলিশের এক আইজিপির ঘনিষ্ঠ ও ব্যবসায়িক সহযোগী ছিলেন। গত উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে তাঁর ডানে-বাঁয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সঙ্গে ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী সঙ্গেও তিনি কাজ করেছেন। তাঁর পক্ষে ভোট চেয়েছেন।’

নুরুল আনোয়ার চৌধুরী আরও বলেন, এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বিএনপি ছেড়ে যাওয়ার পর এলাকায় একটি কমিটিও ছিল না। এরপর নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করে বিএনপিকে সংগঠিত করেছেন তাঁরা। অথচ বিএনপি নেতাদের বাদ দিয়ে জসিমকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তাঁকে মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানান এই বিএনপি নেতা।

জসিমকে বাদ দিয়ে দলের যে কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান মনোনয়নপ্রত্যাশী ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জসিম আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। অথচ বিএনপি তখন নির্বাচন বর্জন করেছে। আওয়ামী লীগের লোকজনই তাঁকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন।’ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে জসিমের মনোনয়ন বিবেচনারও অনুরোধ করেন এই বিএনপি নেতা।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে জসিম উদ্দিন আহমদের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। জসিম মনোনয়ন পাওয়ার পর গতকাল রাতে চন্দনাইশ উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সালাউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে এলাকায় আনন্দমিছিল করা হয়। সালাউদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। জসিম আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি সৌদি আরবের মক্কা বিএনপির সহসভাপতি ছিলেন।’ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে সখ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জসিম একজন ব্যবসায়ী। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির সম্পর্ক থাকতে পারে।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর বাড্ডার এক হত্যাচেষ্টা মামলায় গত বছরের ৪ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন চন্দনাইশের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন। ওই মামলার অভিযোগে বলা হয়, বাদী মো. দুর্জয় আহম্মেদ (২৮) গত বছরের ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করে মধ্যবাড্ডা ইউলুপের নিচে পোস্ট অফিস গলি মাথায় অবস্থান করছিলেন। সে সময় আওয়ামী লীগের ‘শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশনায়’ তাদের অনুসারীরা এলোপাতাড়ি গুলি করলে বাদীর দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া মাথায় পেছনেও গুরুতর আঘাত পান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯০ জনের নামে মামলাটি দায়ের করা হয়। সেখানে জসিম উদ্দিন আহমেদকে ২১ নম্বর আসামি করা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ১০ জুলাই পদ্মা ব্যাংকের ঋণখেলাপির এক মামলায় চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত জসিম উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী তানজিনা সুলতানাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। তারও আগে গত ৩০ এপ্রিল ঋণখেলাপির মামলায় জসিম ও তাঁর স্ত্রীকে পাঁচ মাসের কারাদণ্ড দিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

এই আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ আনতে জসিম উদ্দিন হাইকোর্টে যান। ঋণের ১৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন জানিয়ে সেখানে তিনি জাল পে-অর্ডারের ফটোকপি দেন। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জামিন স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর তাঁর জামিন বাতিল করে হাইকোর্ট।