
গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের ছররা গুলিতে দুই চোখের আলো নিভে যায় মাহবুব আলমের (২৯)। এক বছর পেরিয়ে গেছে, দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করিয়েও চোখের আলো ফেরেনি। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, উন্নত দেশে চিকিৎসা করানো গেলে কিছুটা সম্ভাবনা আছে; কিন্তু পরিবারের পক্ষে তা সম্ভব নয়।
গত বছর মাহবুব আলম নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। চোখ হারানোর পর এখন একা চলাফেরা করতে পারেন না, সব সময় সহায়তা প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে চোখ হারানোর আট মাস পর স্ত্রীও ছেড়ে গেছেন তাঁকে।
গত শনিবার দুপুরে আন্দোলনের এক বছর উপলক্ষে শহরের মিশনপাড়া এলাকার বাসায় কথা হয় মাহবুব আলমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চোখের আলো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে সবই যেন শেষ হয়ে গেছে। আমার স্ত্রীও ছেড়ে গেছে। আমার কারণে পরিবারের সবাইকে কষ্ট পেতে হচ্ছে। চোখ নেই বলে ফ্যাসিস্টমুক্ত নতুন বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছি না, এটাই আমার সবচেয়ে কষ্টের।’
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে চাষাঢ়া মোড় ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নেন ছাত্র-জনতা। মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ। পুলিশ ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা ও এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। সেদিন ছোট শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নিতে গিয়ে পুলিশের ছররা গুলি মাহবুবের মাথা ও চোখে বিদ্ধ হয়। পরে রাজধানীর চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ভারতের চেন্নাই এবং থাইল্যান্ডে তাঁর চিকিৎসা হয়; কিন্তু চোখের আলো ফেরেনি।
মাহবুবের মাথার বাঁ পাশে এখনো ৩২টি এবং চোখের ভেতরে ৯টি ছররা গুলি রয়ে গেছে। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাঁর চোখের নার্ভ ছিঁড়ে গেছে, পর্দা ফেটে গেছে এবং গুলি মাথার হাড় ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেছে।
চিকিৎসায় এরই মধ্যে ১২ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এর অধিকাংশই খরচ করেছে পরিবার। কেবল জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছেন। পরিবারের পক্ষে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। এর মধ্যে গত ২২ মে মাহবুবের বাবা মশিউর রহমানের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। চিকিৎসা খরচে পরিবার এখন চরম সংকটে।
এক বছর আগে মাহবুব বিয়ে করেছিলেন। চোখ হারানোর আট মাস পর স্ত্রী নাজিফা ইসলাম তাঁকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যান।
হালিমা বেগম ও মশিউর রহমান দম্পতির বড় সন্তান মাহবুব। তাঁর মেজ বোন সামিয়া রহমান বিবিএ চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট বোন তহুরা পড়ে দশম শ্রেণিতে। মাহবুব বলেন, ‘চোখের আলোর সঙ্গে সব হারালেও আমি ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ চাই। যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো ফ্যাসিস্ট তৈরি না হয়।’
পাশে বসা মা হালিমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে। গুলি না চালালে এত মানুষ শহীদ হতো না, মাহবুবও চোখ হারাত না। এখন সে একা চলতে পারে না। ছোট শিশুর মতো তাঁকে আগলে রাখতে হয়।’ হালিমা বেগমের চাওয়া, মাহবুবসহ গুরুতর আহত ব্যক্তিদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং শহীদ ও আহত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা হোক।